X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

অনেক প্রশ্ন-অনেক সূত্র

হারুন উর রশীদ
০৪ মার্চ ২০১৬, ২১:১৫আপডেট : ০৪ মার্চ ২০১৬, ২২:৫৯

হারুন উর রশীদ ঘটনাটা আমরা যখন প্রথম জেনেছি তখন সংবাদমাধ্যম বলছিল একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁর খাবার খেয়ে বনশ্রীর দুই শিশু নুসরাত আমান অরণী(১২) আর আলভি আমান(৬) মারা গেছে। কিন্তু আড়াল করা ঘটনা বেরিয়ে আসতে শুরু করে সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের পর। আর এটা এখন নিশ্চিত যে দুই শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। শিশুদের বাবা মো. আমানউল্লাহ আমানের দায়ের করা মামলায় এখন একমাত্র আসামি তাদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। ব্যস, এখন লাগামছাড়া গল্প শুরু হয়ে গেছে এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমে। আর এই গল্পের ভিত্তি র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদ ও সংবাদ সম্মেলন।
এপর্যন্ত আমরা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে তথ্য জানি তা একটু সংক্ষেপে বলে নেওয়া ভালো।
এক. হত্যাকাণ্ডটি ঘটে সোমবার রাতে। পরিবারের সদস্যরা শিশু দুটিকে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানোর সময় বলেছিল- একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে বিষক্রিয়ায় তারা অজ্ঞান হয়েছে। আর এই চায়নিজ রেস্টুরেন্টের খাবারের কথা নাকি মা-ই বলেছেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা শিশু দুটিকে মৃত ঘোষণা করেন।
দুই. মঙ্গলবার সকালে শিশু দুটির লাশ নিয়ে দাফনের জন্য বাসার সবাই গ্রামের বাড়ি জামালপুরে চলে যান। ওই দিনই লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা জানান- শিশু দুটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের চোখে রক্ত জমাটবাঁধা ছিল।
তিন. হত্যাকাণ্ডের ৪৮ ঘণ্টা পর বুধবার নিহত শিশুদের বাবা মো. আমানুল্লাহ আমান, মা মাহফুজা মালেক জেসমিন ও খালা আফরোজা মিলাকে জামালপুর থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় নিয়ে আসে র‌্যাব।
চার. বৃহস্পতিবার র‌্যাব দাবি করে- জিজ্ঞাসাবাদে মা মাহফুজা মালেক জেসমিন দুই শিশুকে শ্বাসরোধ করে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। র‌্যাবের দাবি- সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানসিক দুশ্চিন্তা থেকেই মা দুই সন্তানকে হত্যা করেন। এর সঙ্গে বাবার জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পাঁচ. বৃহস্পতিবার রাতে ঘটনার চারদিন পর শিশু দুটির মা মাহফুজা মালেক জেসমিনকে একমাত্র আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করে তাদের বাবা মো. আমানুল্লাহ আমান রামপুরা থানায়।

ছয়. শুক্রবার মা মাজফুজা মালেক জেসমিনকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

ঘটনার এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনার এবার একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। আর সেই বিশ্লেষণ আমি উপস্থাপন করতে চাই প্রশ্ন আকারে-

প্রশ্ন-১: মা’সহ বাসায় হত্যাকাণ্ডের সময় অন্তত তিনজন ছিলেন। আর শিশু দুটির বয়স ১২ ও ৬ বছর। একা মায়ের পক্ষে এই দুটি শিশুকে হত্যা করা সম্ভব কিনা? বাসায় তখন খালা ও দাদি কী করছিলেন। বলা হচ্ছে- অরণীর সঙ্গে মায়ের ধস্তাধস্তিও হয়েছে। আর এটা আর কেউ টের পেলেন না তা কি বিশ্বাস করা যায়?

প্রশ্ন-২: খবর পাওয়ার পর বাবা মো. আমানুল্লাহ বাসায় এলেন, একটি গাড়িতে করে তার দুই শিশুকে হাসপাতালে পাঠানো হলো। সেই গাড়িতে অপরিচিত দুজন লোক ছিল। তারা কারা? আমানুল্লাহ কেন বিষয়টি হত্যাকাণ্ড মনে করলেন না?

প্রশ্ন-৩: চাইনিজ রেস্টুরেন্টের খাবার খাওয়ার গল্পটি ছড়ানো হলো কেন? এই গল্প কি মা ছড়িয়েছেন? তিনি একা এই গল্প বানালে আর সবার তো তা বিশ্বাস করার কথা নয়। তাহলে বাসার সবাই কেন একই গল্প বললো। তাহলে কি হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে সবাই মিলেই এই গল্প তৈরি করলো? কেন তারা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল, এমনকি বাবাও!

প্রশ্ন-৪: বাবাসহ পরিবারের সব সদস্য কেন লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিতে চেয়েছিলেন? আর কেনই বা তারা সবাই দ্রুত গ্রামের বাড়িতে চলে যান?

প্রশ্ন-৫: নিয়ম অনুযায়ী থানা-পুলিশ সক্রিয় না হয়ে কেন হঠাৎ র‌্যাব সক্রিয় হলো। আর কেনই বা তারা তাদের প্রাপ্ত তথ্য থানা পুলিশকে না জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রচার করলো।

প্রশ্ন-৬: নিহত শিশু দুটির বাবা মামলা করলেন চারদিন পর। আর একমাত্র আসামি করলেন শিশুদের মাকে। এটি যে হত্যাকাণ্ড এটা বুঝতে তার চারদিন লাগলো? এর আগে তিনি পুলিশকে কোনও ধরনের অভিযোগ বা তথ্য না দেওয়ার কারণ কী? আর তিনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে, মা-ই একমাত্র হত্যাকারী?

প্রশ্ন-৭: এখানে কি একজনই হত্যাকারী না এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড? মা একাই দায়ী নাকি তাকে বলির পাঠা করা হয়েছে?

প্রশ্ন-৮: হত্যাকাণ্ডের পর স্বাভাবিক ছিলেন মা, তাহলে আর সবাই কীভাবে স্বাভাবিক ছিলেন?

প্রশ্ন-৯: র‌্যাব কীভাবে নিশ্চিত হলো যে, শিশুদের বাবা এই হত্যাকাণ্ডে কোনওভাবেই জড়িত নন? বাসায় না থাকলেই কি তা প্রমাণ হয়?

প্রশ্ন-১০ শিশু দুটির গলা এবং মুখে আঘাত ও শ্বাসরোধের স্পষ্ট আলামত থাকার পরও বাবা এবং বাসায় থাকা খালা ও দাদি কেন এটাকে বিষক্রিয়াই ভাবলেন?

হত্যাকাণ্ডের কারণও জানিয়েছে র‌্যাব। তারা মাকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ‘সন্তানদের পড়ালেখা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের কারণেই মা তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন।’

মামলার এজাহারে নিহত শিশুদের বাবা বলেছেন, ‘ছেলে-মেয়ে রেজাল্ট খারাপ করায় আমার স্ত্রী টেনশন করেন। তার মাথায় যন্ত্রণা হয়। সে আমাকে জানায় ছেলে-মেয়ে না থাকলে টেনশন হতো না। ওই টেনশন ও যন্ত্রণার কারণে ছেলে-মেয়েকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। মেয়ে নুসরাত আমান অরণীকে খাট থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর ঘুমন্ত ছেলে আলভি আমানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।’

এজাহারে আমানউল্লাহ আমান বলেছেন, ‘তবে আমার স্ত্রী মাহফুজা মালেক জেসমিন তার টেনশনের কথা আমার কাছে কোনওদিন প্রকাশ করে নাই।’

তাই যদি হয়, তাহলে তিনি এখন তা কীভাবে জানলেন? তার এজাহার আর র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া র‌্যাব কর্মকর্তাদের বক্তব্য হুবহু এক।

একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী- ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের ২০১৫ সালের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় অরণী ৮২০ নম্বরের মধ্যে ৫২৭ নম্বর পেয়েছিল। ক্লাসে ১১০ দিনের মধ্যে ৯৮ দিন উপস্থিত ছিল। নুসরাতের পড়ালেখা সম্পর্কে স্কুলটির অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘নুসরাতের শ্রেণি শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওর ফল ভালো ছিল। খুব সৃষ্টিশীল ছিল, ভালো ছবি আঁকত।’

আলভী সম্পর্কে হলি ক্রিসেন্ট (ইন্টারন্যাশনাল) স্কুলের প্রভাতি শাখার সমন্বয়ক মেহেদি মাসুদ বলেন, ‘আলভী ছিল নার্সারির ছাত্র। সে প্লে গ্রুপ থেকে নার্সারিতে ওঠার সময় ষষ্ঠ হয়েছিল। নিয়মিত স্কুলে আসত।’

সন্তানদের পড়াশোনার এই রেজাল্টে মা চিন্তিত হতেই পারেন। তিনি আরও ভালো রেজাল্টের প্রত্যাশা করতেই পারেন। কিন্তু তা কি সন্তান হত্যার মতো বিধ্বংসি মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারে?

মামলার এজাহারে আরেকটি নতুন তথ্য দিয়েছেন শিশুদের বাবা মো. আমানউল্লাহ আমান। তিনি বলেছেন, ‘শিশুদের হত্যার পর মাহফুজা মালেক জেসমিন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানতে পেরেছি।’

এজাহারের এই বক্তব্য আগে আর শোনা যায়নি। এখন কেন বলা হচ্ছে? মা জেসমিনকে মানসিক রোগী হিসেবে দেখালে কার লাভ? কারা বেঁচে যাবেন?

সংবাদ সম্মেলনের আগে বৃহস্পতিবার সকালে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। আর তাতে তিনি বলেন, ‘Mental anxiety, family / social disorder, Psychological illness, extra marital affair, grabbing of wealth & property etc are the main causes of child killing . RAB has apprehended the main suspect Mrs Mahfuja Maleq @ Jesmin, the mother of two siblings (aroni and alvi ). Both the child were killed by their own mother on 29 Feb 2016 approx 5 pm in Rampura Banasree due to family crisis.’

অনেক কারণ তিনি উল্লেখ করেছেন। এসব কারণ যদি সত্য হয় তাহলে এটা কোনও একক বিষয় নয়। এখানে সম্মিলিত অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মামলার এজাহারে তার কোনও প্রতিফলন নেই কেন? আর এসব কারণ নিয়ে কিছু সংবাদমাধ্যম রগরগে কাহিনী প্রচার করছে।

আর তিনি যে কারণগুলোর কথা বলেছেন তার মধ্যে সম্পদ এবং সম্পত্তি আত্মসাতের কথা রয়েছে। এই দুই শিশুর সঙ্গে সম্পদ এবং সম্পত্তি আত্মসাতের কী সম্পর্ক? আর যদি থাকেই তাহলে শিশু দুটিকে হত্যা করে মা তো সম্পদ আর সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবেন না। তাদের হত্যা করে কারা লাভবান হবেন? তা জানা খুব জরুরি।

সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দেশের মানুষের আলোচনায় এখন এই দুই শিশু হত্যাকাণ্ড। আমার বন্ধু আমিনুল ইসলাম সজল এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত। তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সহকারী জজ হিসেবে। কিছুদিন একটি প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকে সাংবাদিকতাও করেছেন। বৃহস্পতিবার তিনি আমার ফেসবুকে ইনবক্স করে বলেছেন, ‘Harun Bhai, We need to be more careful about the privacy of the people being accused. . . children/adult everybody. Law enforcers, journalists, social media users everybody. . . . fact/news stories can be done concealing the identity etc. . . . I know in the current competitive media environment, it's difficult. But somebody, somewhere it needs to start. . . abiding the basics. . .,you may write something on this. . ’

সজলের সঙ্গে আমিও একমত। সংবাদ সম্মেলন করে একজনকে খুনি বানিয়ে দেওয়ার আগে শতবার ভাবতে হবে। থাকতে হবে পর্যাপ্ত তথ্য। সব প্রশ্নের জবাব পেতে হবে। তার আগে নয়। আর সব কথা কেন র‌্যাব বা পুলিশকে বলতে হবে। তারা বললেই সংবাদমাধ্যমকে তা প্রকাশ করতে হবে কেন? সংবাদমাধ্যমেরও তো গেটকিপার থাকার কথা। অনেক বিষয় আছে আদালতের, তা আদালতেরই করা উচিৎ। আর আমরা শুরুতেই পরিচয় প্রকাশ করে দিয়ে কাউকে যখন অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করি তখন তো ব্যক্তি গোপনীয়তা লঙ্ঘনের প্রশ্ন উঠবেই।

দুই শিশুর মা এখন পাঁচ দিনের রিমান্ডে। তাকে আদালতে হাজির করার ছবি ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে। তিনি মুখ ঢাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমরা কেন মুখ ঢাকছি না। হত্যাকাণ্ডের পর তিনি নাকি নির্বিকার ছিলেন। তিনি একা কেন বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও তো নির্বিকার ছিলেন। আমরা কেন এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছি না। আমরা কেন প্রশ্ন তুলছি না যে, বাবাসহ সবাই কেন হত্যাকাণ্ডের পর চারদিন চুপ ছিলেন?

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: swapansg@yahoo. com

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিলেছে ২৭ বস্তা টাকা
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিলেছে ২৭ বস্তা টাকা
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ