X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইউপি নির্বাচন: যুগে যুগে

আনিস আলমগীর
১০ মার্চ ২০১৬, ১১:৫৫আপডেট : ১০ মার্চ ২০১৬, ১১:৫৭

Anis Alamgirদেশব্যাপী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শুরু হচ্ছে। এবারের নির্বাচনটা হচ্ছে দলীয়ভিত্তিতে দলীয় প্রতীক নিয়ে। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশের সময়ে চৌকিদারি আইন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রথম স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলর প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছিলো। স্থানীয় সরকারের এ প্রাথমিক স্তরটি খুবই প্রাচীন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খাঁন তার রচিত ও প্রদত্ত শাসনতন্ত্রে ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যদের দিয়েই ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ গঠন করেছিলেন।পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ হাজার করে সর্বমোট ৮০ হাজার সদস্য নির্বাচিত হতো প্রত্যক্ষ ভোটে আর তারাই ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, জাতীয় পরিষদের সদস্য ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতেন। এ প্রথাকে বেসিক ডেমোক্রেসি প্রথা বলা হতো।
এর আগে কিন্তু প্রত্যক্ষ ভোটেই সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে ১৯৫৪ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনও শাসনতন্ত্র ছিলো না। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দিয়েই পাকিস্তান চলতো। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণ-পরিষদে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়েছিলো। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র গৃহীত হওয়ার পর পরই প্রত্যক্ষ ভোটে ইউনিয়ন কাউন্সিরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তখন ইউনিয়ন পরিষদের প্রধানকে প্রেসিডেন্ট বলা হতো। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলো। এই শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ছিলো কিন্তু ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খাঁন দেশে সামরিক শাসন জারি করে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল করে দিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে তার প্রদত্ত শাসনতন্ত্র বহাল হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসন বহাল ছিলো।

তখন দেশে কোনও রাজনৈতিক দল ছিলো না। রাজনীতিও নিষিদ্ধ ছিলো। ১৯৬২ সালের শাসতন্ত্র কোনও গণ পরিষদ রচনা করেনি। এটি আইয়ুবের এক ব্যক্তির রচিত ও প্রদত্ত শাসনতন্ত্র ছিলো। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ভাষ্য অনুসারে সাধারণ মানুষ ভোটের অধিকার প্রয়োগের উপযুক্ত ছিলো না বলে তিনি প্রত্যক্ষ ভোটের ব্যবস্থা রহিত করে তার শাসনতন্ত্রে বেসিক ডেমোক্রেসি প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন।

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্মের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণ-পরিষদ গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র রচনা করে। এই শাসনতন্ত্র গৃহীত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে নব-প্রণীত শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রত্যেক্ষ ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশে সব স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ছিলো। কোনও সময়েই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন দলভিত্তিক হয়নি। পূর্বে সমাজে কিছু শক্তিশালী লোকের বিচরণ ছিলো। তারাই সাধারণত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করতেন। তাদের ৮০% লোক নির্দলীয় লোক ছিলেন। চকিদার/দফাদার ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা দেখাশোনা করার জন্য কোনও লোক ছিলো না। কিন্তু শক্তিশালী লোকগুলোর কারণে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকতো। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের অভ্যূদয় হওয়ার পর এ শ্রেণির লোকগুলো বিভিন্ন কারণে উচ্ছেদ হয়ে যায়। এতে করে সমাজের উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য স্থান কোনওদিন শূন্য থাকে না। ধীরে ধীরে তাদের স্থানে আরেক দল লোকের আবির্ভাব হয়। কিন্তু কমরেড আব্দুল হক, কমরেড তোয়াহা, মতিন আলাউদ্দিন, সিরাজ সিকদার, টিপু বিশ্বাস, অহিদুর রহমান, মতিন মাস্টার ও জিয়াউদ্দীন প্রমুখ কমরেডদের গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী তৎপরতায় গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতাবান-শক্তিশালী লোকেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিপ্লবের হিড়িক পড়েছিলো। বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া, মুৎসুদ্ধি এমন শব্দগুলো তখন ক্ষেতে খামারের ছড়িয়ে পড়েছিলো। বিপ্লবীরা বহু চেয়ারম্যান মেম্বার হত্যা করেছে। বরিশালে ঈদের জামাতে তারা দু’জন এমপিও হত্যা করেছিলো। রাতের অন্ধকারে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক স্লোগান শোনা যেত কিন্তু বিপ্লব ও বিপ্লবীরা কেউই দীর্ঘজীবী হয়নি। সমাজটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ তখন যুদ্ধ বিধ্বস্থ সমাজটা পুণগঠনের জন্য সমাজ-সংহতিরই প্রয়োজন ছিলো বেশি। গত শতাব্দীর ৭ দশকে বাংলাদেশেও পশ্চিম বাংলায় বিপ্লবীরা গ্রামাঞ্চলে অনাচারে লিপ্ত হয়েছিলো। মেম্বার-চেয়ারম্যান, ১০/১৫ বিঘা জমিওয়ালা কৃষকদের মাথা কাটা যেন বিপ্লবীদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কারণ তারা নাকি বিপ্লবের শত্রু। কলকাতায় রাস্তার পার্শ্বে স্থাপিত রবীন্দ্রনাথ, রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা ভেঙে কনিস্কের মূর্তির মতো করে দিতো। বিপ্লবীরা বলতো এরাও নাকি বুর্জোয়া ছিলো। বিপ্লব শনিগ্রহের মতো। অনেক সময় নিজেই নিজের সন্তান খেয়ে পেলে। উভয় বাংলায় তাই হয়েছিলো। বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর কর্মীরা গণ-ডাকাতিতে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলো। বৃহত্তর যশোহর, বৃহত্তর খুলনা, বৃহত্তর রাজশাহী, বৃহত্তর পাবনা, বৃহত্তর বরিশালে বিপ্লবের কর্মীরাই ডাকাতি করতো। অনেক সময় মাছের ঘের দখল করতে ভাড়া খাটতো। জিয়ার আমলে খুলনায় সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতের ভাড়া খেটেছিল বিপ্লবীরা। আজকে ইসলামিক বিপ্লবের যে সব কর্মী তৎপর  তাদের পরিণতিও একদিন অনুরূপ হবে।

দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা আসার পর বিএনপি বা জাতীয় পার্টি উল্লেখযোগ্য তেমন কোনও বিরোধীতা করেনি বরঞ্চ তারা নিজেরাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছেন। অবশ্য বিএনপির জন্য বাড়াবাড়ির কোনও সুযোগ নেই। গত তিন বছরের আন্দোলনে দল যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ধীরে ধীরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দলের সুস্থতা ফিরিয়ে আনা ছাড়া বিকল্প চিন্তা তাদের পক্ষে আপাতত সম্ভব নয়। কোনও কোনও এলাকায় বিএনপির কোনও প্রার্থী নেই। যে সমস্ত এলাকায় গত তিন বছরের আন্দোলনে দলের মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়েছে সম্ভবতো সে সব এলাকায় প্রার্থী পাওয়া মুশকিল হয়েছে। অসুস্থ রাজনীতির পথে ফিরে না গেলে বিএনপির আবারও গা জাড়া দিয়ে উঠতে পারবে। এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক বিশ্লেষকই একমত।

জাতীয় পার্টি নাকি অর্ধেক ইউনিয়ন পরিষদে প্রার্থী দিতে পেরেছে। তৃতীয় বিশ্বে যে সব সামরিক একনায়ক ক্ষমতা দখল করেছিলেন তারা সবাই ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর শেষ হয়ে গেছেন। কিন্তু এরশাদের ভাগ্য ভালো তিনি এখনও তার দল জাতীয় পার্টি নিয়ে কোনও রকমে টিকে আছেন। তিনি যদি রাজনীতি করতে জানতেন তবে নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু তিনি এতো বেশি অস্থির এবং এতো বেশি কথা বলেন যে- কথায় কথায় সব নিঃশেষ করে দিয়েছেন। এখনও তার দলে কিছু লোক আছেন কিন্তু তিনি সংযত না হলে তার দলে তিনি, তার স্ত্রী ও তার ভাই ছাড়া আর কেউ থাকবেন না। সব সময় দেখা গেছে তার কথাতেই তার দলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সংগঠন করতে খাঁটি ভেজালহীন বিরোধীদল হতে হবে কথা নেই।

রাশেদ খান মেননের দল ওয়াকার্স পার্টি বর্তমান সরকারে অংশগ্রহণ করেছে কিন্তু কয়েকদিন আগে তিনি তার দলের কৃষক সমিতির নড়াইলের জাতীয় সম্মেলন করেছেন। ইনুও তাই করছেন জাসদের হয়ে। এরশাদেরও উচিত জেলা উপজেলা সফর করে জেলা উপজেলার কমিটিগুলোকে সাংগঠনিকভাবে মজবুত করার চেষ্টা করা। এ পদ্ধতিতে সংগঠন করে গেলে নির্বাচন আসলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। নির্বাচনের সময় মরাগাঙেও জোয়ার আসে।

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন নির্বাচনি ব্যবস্থা নাকি ভেঙে পড়েছে। ঢাকায় লোকেরা বলাবলি করে এনজিওগুলো আতঙ্কিত হওয়ার মতো কথা না বললে নাকি বিদেশ থেকে টাকা পায় না। মজুমদার সাহেবের কথাও সে উদ্দেশ্যে কিনা জানি না। যাহোক, নির্বাচন কমিশনের উচিত শক্ত হাতে নির্বাচন পরিচালনা করা। সরকারের উচিত সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে কোনও দল ক্ষমতাসীনও হবে না আর কোনও দল ক্ষমতাচ্যুতও হবে না।

পরিশেষে বলবো, এবার যে দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে তাতে দেশের বিভক্তির রাজনীতিটা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে গেলে হয়ত জাতির জন্য খারাপ ফলও বয়ে আনতে পারে। পশ্চিম বাংলায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় তাই হয়েছে। সরকার যেন এবারের দলীয়ভিত্তিক নির্বাচনটা ট্রায়েল হিসেবে দেখেন। ফলাফল ভালো না হলে ভবিষ্যতে যাতে পদ্ধতিটা বাতিল করতে পারেন।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
গ্লোবাল স্কিলস ফোরামে বক্তারাবাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ