X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

১/১১: হিংসা ও অহিংসা

শুভ কিবরিয়া
১২ মার্চ ২০১৬, ১৯:২৪আপডেট : ১২ মার্চ ২০১৬, ২২:৩৮

শুভ কিবরিয়া ১/১১ নিয়ে এখন সরগরম বাংলাদেশের মিডিয়া ও রাজনীতি। ১/১১ নামটিই আসলে পশ্চিমা অনুকরণ। পশ্চিমা রীতির অনুকরণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক কালো দিনকে এই নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ আমরা আমাদের রাজনীতির কোনও দুঃখের দিনকে অতীতে কখনও এইভাবে নামকরণ করিনি। পলাশীর আম্রকাননে মীর জাফরের দুঃখজনক বিশ্বাসঘাতকতার দিন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক দুঃখদিন এসেছে কিন্তু আমরা এ ভাবে তার নামকরণ করিনি।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক বিয়োগান্তক ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু উচ্চাভিলাষী সদস্য। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঘটে আরেক বিয়োগান্তক বর্বর ঘটনা। নিরাপদ আশ্রয় বলে স্বীকৃত জেলখানায় নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ বাংলাদেশের প্রথম সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মন্ত্রী এম মনসুর আলীসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এ এফ এম কামরুজ্জামানকে। আমাদের রাজনীতিতে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ অনেক উথাল-পাতাল ঘটনা ঘটেছে। এরপরে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। একজন রাষ্ট্রপতি গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। রাজনীতির এসব উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহের কোনওটিকেই আমরা এ রকম সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে গ্রহণ করিনি। কিন্তু ১/১১-এর রাজনৈতিক ঘটনাকে এ রকম সাংকেতিক অবয়ব দিয়ে গ্রহণ করেছি। কারণ এই নাম এসেছে আমেরিকায় ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনায় টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দিনকে তাদের মতো করে ৯/১১ নামকরণ প্রথার অনুকরণের মধ্য দিয়ে।
দুই.
১/১১ কিভাবে এলো? ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় আমাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় পশ্চিমা চাপে রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একসময় চলে যায় সেনা সমর্থিত অরাজনৈতিক সরকারের হাতে। আমাদের রাজনৈতিক সহিংসতার  ফল হিসেবে আবির্ভূত হয় ১/১১, আপাত অহিংসার চেহারা নিয়ে। কিন্তু অচিরেই সেই অহিংসা ফনা তোলে রাষ্ট্রীয় অনায্য সহিংসতায়। মনে রাখা দরকার তখন কী ঘটেছিল?
বিরোধী দলগুলোর কড়া রাজনৈতিক প্রতিবাদের মুখে ২০০৬ সালের শেষের দিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহাম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেন। এ নির্বাচন সাজানো অভিযোগ তুলে প্রায় সবগুলো বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে দৃশ্যত দেশি-বিদেশি চাপের মুখে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এরপরই তার সরকার বিলুপ্ত করে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন।  

 

তিন.
মনে রাখতে হবে আমরা রাজনীতিতে কখনওই অহিংসার বীজ বপণ করিনি। আমাদের রাজনীতিতে বড় জায়গা পেয়েছে প্রতিপক্ষকে বরাবর উচ্ছেদ ও নির্মূল আকাঙ্ক্ষা। আমরা বারবার চেয়েছি যে কোনও মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে। কিংবা যে কোনওভাবে ক্ষমতার মসনদ দখল করতে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার কৌশলও যে রপ্ত করার বিষয়, সেটাও যে রাজনীতির সৌন্দর্য্য, সেই সত্যটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কখনও মানেনি। শেখেওনি। বিশেষ করে যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে সেই দল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী ভেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে শক্তির নীতিতে বিজয়ী হতে চেয়েছে। এই নীতিভ্রষ্টতার হাত ধরেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ব্যত্যয় ঘটেছে বলেই

২০০৭ সালের ২২ শে জানুয়ারি সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য  নির্বাচন করা যায়নি। তাই অনিবার্যভাবেই ১/১১ এসেছে। এখন যত আপ্ত্যবাক্যই বলা হোক না কেন ১/১১ আমাদের স্বাভাবিক রাজনীতির ব্যর্থতা ও দূর্বলতার ফাঁক গলেই এসেছে। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোটের অনায্য একগুয়েমি আর গায়ের জোরের রাজনীতির কারণে সে সময় ন্যূনতম মানসম্পন্ন একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যায়নি । আওয়ামী লীগসহ অন্য দলগুলো তখন যেকোনও মূল্যে ওই সরকারের পতন চেয়েছে। আর সে কারণেই ১/১১ এলে আওয়ামী লীগ তখন সেই সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে প্রকাশ্যেই।

তারপরে ১/১১ সরকার নিজেরা রাজনীতিতে উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে। তারাও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতই নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করতে থাকে। নিজেরা আইনের ন্যায্যতার দণ্ড নিজেদের অনায্য ইচ্ছাপূরণের কাজে লাগাতে থাকে। যে কারণে তখন মানুষ ১/১১-কে গ্রহণ করেছিল সেই কারণ লঙ্ঘিত হতে থাকে তাদের হাতেই। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের বদলে তারা মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর করার খেলায় মেতে ওঠে। তৎকালীন সেনা সরকারের অনেকেই আইন বহির্ভূত অনাচার চালাতে থাকে।

অবশেষে সেই সরকারকেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়। তবে লক্ষণীয় সেই সরকারের সঙ্গে ওপরে একরকম ও ভেতরে অন্যরকম দেনদরবার চালাতে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো। আজ এ কথা বাজারে চাউর হচ্ছে যে নিজেকে নিরাপদ রাখতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও তলে তলে আঁতাত করে দলের নেতৃত্ব ভাইস চেয়ারম্যানের হাতে অর্পণ করেন। এই গোপন ও প্রকাশ্য দেনদরবার ও আঁতাত মেনেই তখনকার রাজনীতি তার পথে হাঁটতে থাকে।

চার.
রাজনীতিতে হিংসার ফসল হিসেবে এসেছে ১/১১। আবার ১/১১ নিজেও হিংসা ছড়িয়েছে। রাজনীতির সেই হিংসার  তাৎক্ষণিক সুফল এসেছে কারও ঘরে। কেও সেই হিংসার আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনও হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতির এক-দশকের লড়াই ছিল সামরিক শাসনের প্রভাব থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পা রাখা। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেক বেশি বৈশ্বিক প্রভাব দ্বারা পীড়িত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আঞ্চলিকতা ও আন্তর্জাতিকভাবে তার নানা লেলিহান যন্ত্রণা প্রবেশ করেছে হিংসার পথ ধরেই। এই হিংসা কতটা আমাদের দ্বারা উৎপন্ন, কতকটা আন্তর্জাতিক কূটকৌশলের প্রভাব। সুতরাং ১/১১ আমাদের নিজেদের রাজনীতির নাটাই অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে অনেকটাই। আমাদের রাজনীতির প্রধান কুশীলবদের বক্তব্য-বিবৃতি ঘাটলে সেই সত্য উদ্ভাসিত হয়।

পাঁচ.
হিংসা রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে কোনও সুফল আনে না। পৃথিবীর কোনও দেশে সেটা আনেনি। সে কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিবিদ নেলসন ম্যান্ডেলা এই আধুনিক সময়েও রাজনীতিতে পুরাতন ও পরীক্ষিত অহিংসা নীতি প্রয়োগ করেন। আমাদের উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী এই অহিংসার নীতি প্রয়োগ করে ব্রিটিশ বিরোধি রাজনৈতিক লড়াইয়ে এক অভূতপূর্ব সাফল্য পান। যদিও সেই অহিংসার পথ থেকে নীতিভ্রষ্টতার কারণেই উপমহাদেশে হিংসার রাজনীতি সাম্প্রদায়িক হানাহানির বেশে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের প্রাণসংহারের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়।

আজ আমাদের বোধোদয় দরকার আমরা হিংসার রাজনীতি সচল রাখব না অহিংসার পথে হাটব। হিংসা হিংসার জন্ম দেবে।হিংসা আরও হিংসা তৈরি করবে। সেই কথাটা মাথায় রেখেই ১/১১ এর একটা সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া দরকার। শুধু পছন্দের শত্রুকে টার্গেট নয় কিংবা কারও প্রতি বিচার কারও প্রতি ক্ষমা এই নীতিও নয়−দরকার একটা ন্যায়ানুগ বিবেচনা। রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে অহিংসা ফিরিয়ে আনতে গেলে ১/১১-এর প্রকৃত অপরাধীদের চেহারাটা উম্মোচন খুব জরুরি। আবার এই শিক্ষাটাও মানা জরুরি যে, প্রকৃত রাজনীতি ব্যর্থ হলে অরাজনীতি বড় হয়ে উঠতে পারে।

আমরা প্রকৃত রাজনীতি যদি ফেরাতে পারি, অহিংসা যদি আমাদের রাজনীতির মন্ত্র হয়ে উঠতে পারে তবে ১/১১-এর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেমন ঠেকানো যাবে, তেমনি একটা সৃজনমুখী জনকল্যাণময় জনসম্পৃক্ত টেকসই রাজনীতির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে দুবাই বিমানবন্দর
ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে দুবাই বিমানবন্দর
সোনার দামে সর্বোচ্চ রেকর্ড
সোনার দামে সর্বোচ্চ রেকর্ড
রাশিয়া জিতে গেলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে: ইউক্রেন
রাশিয়া জিতে গেলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে: ইউক্রেন
কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের সঙ্গে মেয়র তাপসের মতবিনিময়
কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের সঙ্গে মেয়র তাপসের মতবিনিময়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ