X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

এক রানের আক্ষেপ!

প্রভাষ আমিন
২৪ মার্চ ২০১৬, ১৬:৩৫আপডেট : ২৪ মার্চ ২০১৬, ১৬:৪১

প্রভাষ আমিন ৩ বলে ২ রান। ক্রিজে আছেন দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যান। শুধু অভিজ্ঞ বলেই নয়,ক্রিজে থাকা দুই ব্যাটসম্যানের টেকনিক বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। দুইজনই নির্ভরযোগ্য। দুজনের বোঝাপড়াও সবচেয়ে ভালো হওয়ার কথা। ম্যাচের এই অবস্থায় ঘোর ভারতীয় সমর্থকও প্রার্থনা করতে পারেন, কিন্তু ভারতের পক্ষে বাজি ধরবেন না। কিন্তু তারপর যা হলো তা ক্রিকেট রূপকথার অংশ হয়ে গেলো। ক্রিকেটকে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা বলা হয় কেন, তার উত্তর হয়ে অনেকদিন দর্শকচিত্তে টিকে থাকবে এই খেলার স্মৃতি। আরেকটু পেছনে গেলে নাটকটা আরও জম্পেশ হয়। শেষ ওভারে জয়ের জন্য চাই ১১ রান।  স্ট্রাইকে গত বিশ্বকাপ থেকে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। আগের ম্যাচেও যিনি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৪৯ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংস খেলেছেন।
ভারতীয় অধিনায়ক এম এস ধোনি বল তুলে দিলেন হার্দিক পান্ডের হাতে। লম্বা সময় ধরে তাকে পরামর্শ দিলেন। শুধু তাই নয়,বলে বলেই টিম মিটিং। প্রথম বলেই রিয়াদ সিঙ্গেল নিলেন। হায় হায় করে উঠলো গোটা বাংলাদেশ। মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের মি. ডিপেন্ডেবল হলেও তার সাম্প্রতিক ফর্মটা ভালো যাচ্ছিল না। তারচেয়ে রিয়াদ থাকলেই তো ভালো হতো। কিন্তু মুশফিক ফর্মে ফেরার জন্য বেছে নিতে চাইলেন মোক্ষম সময়টাই। পান্ডেকে পরপর দুটি চার মেরে সমীকরণটা নিয়ে এলেন ৩ বলে ২ রানের অনায়াস জয়ে। দুই ভায়রা দুটি সিঙ্গেল নিলেই হয়। তখনই পাগলামির ভুত ভর করলো মুশফিকের মাথায়। টেস্টে বাংলাদেশের একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরির মালিক মুশফিক মাথা ঠাণ্ডা করে খেলেন, যা টি-২০এর সাথে ঠিক যায় না।
এখন তো মাথা ঠান্ডা রেখেই খেলার সময়। তখনই হঠাৎ হিরো হবার শখ জাগলো তার। তবু পান্ডের বলে দেখিল সে কোন ভুত? ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে আউট। তখনও ম্যাচে বাংলাদেশই। কারণ ততক্ষণে স্ট্রাইকে চলে গেছেন রিয়াদ। কিন্তু মুশফিক কি যাওয়ার সময় তার ভায়রা ভাইকে হিরো হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা বলে গিয়েছিলেন? নাকি ভুতটা মুশফিকের মাথা থেকে রিয়াদের মাথায় চালান হয়ে গিয়েছিল? পান্ডের ফুলটস বলটি যে কোনও ব্যাটসম্যানের জন্য লোভনীয়। পেলেই ছক্কা মারতে চাইবেন। কিন্তু তখন তো বাংলাদেশের ছক্কার দরকার নেই। ৮৬ সালে শারজায় শেষ বলে ছক্কা মেরে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানকে জিতিয়ে নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন জাভেদ মিয়াদাদ। তেমন আকাঙ্ক্ষা থেকেই হয়তো পান্ডে ফাঁদে পা দিলেন রিয়াদ। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। এই পাগলামি মুশফিক আর রিয়াদের দুঃস্বপ্নে হানা দেবে বহুকাল। রিয়াদের দুঃখটা বেশি। চারবছর আগে এই ২৩ মার্চেই এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২ রানের মহাকাব্যিক পরাজয়েও যে ক্রিজে ছিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদই। তিনি হিরো হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটা জিনিস প্রমাণিত হলো রিয়াদ শুধু বাংলাদেশের আনসাং হিরো নয়, ট্র্যাজিক হিরোও। শেষ বলে দরকার ২ রান। তাও অসম্ভব নয়। স্ট্রাইকে স্বীকৃত অলরাউন্ডার শুভাগত হোম। সত্যিকারের নায়ক হওয়ার সুযোগ ছিল তার সামনেও। কিন্তু বলে ব্যাটই লাগাতে পারলেন না। তাও পরিমরি ছুটলেন। কিন্তু শেষ হলো না তাও। রানআউট। ৩ বলে ২ রানের বদলে ৩ রানে ৩ উইকেট।

অভাবিত, অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য!

ষোল কোটি মানুষের হাহাকার, কান্না, আর ‘ইশ’ ধ্বনি অনেকদিন বাংলাদেশের আকাশে অনুরণন তুলবে। খেলার পরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে সে হাহাকার, কান্না। বাংলাদেশের অনেক মানুষ রাতে ঘুমাতে পারেননি। সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে বুকে ব্যথা নিয়ে। অনেকে বলেছেন, তারা আর বাংলাদেশের খেলা দেখবেন না। কারণ এত চাপ সইবার মত শক্ত নয় তাদের হৃদয়। রাতে বা সকালে হৃদরোগের হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিলে দেখা যেতো রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে কিনা। আমি সবসময় বলি খেলা খেলাই। খেলা আনন্দের জন্য, বেদনার জন্য নয়। সিরিয়াসলি না নিয়ে আমি সবকিছু স্পোর্টিংলি নিতে বলি। গত বইমেলায় প্রকাশিত আমার একটি বইয়ের নামই ‘স্পোর্টিংলি নাও’। সকালে একজন ফোন করে বললেন, ভাই সবকিছু স্পোর্টিংলি কিভাবে নেব? এত কষ্ট যে সইতে পারছি না। আরে ছাই, তাকে কি জবাব দেব। আমি নিজেই কি স্পোর্টিংলি নিতে পেরেছি। বুকে ব্যথা নিয়েই যে ঘুমাতে গিয়েছি। ঘুম ভেঙ্গেছেও ব্যথা নিয়েই। ৩০ রানের পরাজয় সওয়া যায়, এক রানের পরাজয়ে কষ্টের সাথে মেশে শোক, আক্ষেপ, আহাজারি।

আমি সববময় বলি, বাংলাদেশের সমর্থকরা বিশ্বের সেরা। কেন বলি, তা আবারও প্রমাণিত হলো। এত যে কষ্ট, এত যে ব্যথা; তারপরও কিন্তু ক্রিকেটারদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কমেনি। যেটুকু ক্ষোভ-বিক্ষোভ, গালাগালি তাও ভালোবেসেই। ভারত হলে ক্রিকেটারদের বাড়িতে ঢিল পড়তো, আগুন জ্বলতো। আমরা বাংলাদেশের পাশে আছি, হারলেও আছি, জিতলেও আছি। ক্রিকেটের প্রতি আমাদের ভালোবাসাটা হলো- এত শঠতা, এত যে ব্যথা; তবু যেন তা মধুতে মাখা।

ঠিক আগের লেখায় আমি একটা ধারণার কথা বলেছিলাম, এখন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের যে উত্তেজনা শিগগিরই তা বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে চলে আসবে। পারফরম্যান্সের অধঃগতি দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে যাবে পাকিস্তান। আর তাদের জায়গা নেবে বাংলাদেশ। আর গত একবছরে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে যে বৈরিতা, তা খেলার উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। আমার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করতে বাংলাদেশ একটি ম্যাচও নেয়নি। অভিনন্দন বাংলাদেশকে। অভিননন্দন অবশ্যই তাদের পাওনা। কোনও কোনও পরাজয় জয়ের চেয়েও বেশি গৌরব বয়ে আনে। গতবছরের ১৯ মার্চ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে অন্যায়ভাবে বাংলাদেশকে হারিয়ে দিয়েছিলেন আলিম দার আর ইয়ান গোল্ড। সেই পরাজয়ই যেন বদলে দেয় বাংলাদেশকে। আসলে সেই ম্যাচে নৈতিক জয় ছিল বাংলাদেশেরই। সেই নৈতিক জয়কে পুঁজি করে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়েছে বাংলাদেশের জয়রথ। সিরিজ হেরেছে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মত শক্তিশালী দলগুলো। ওয়ানডেতে সাফল্য এলেও টি-২০তে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স আশানুরূপ ছিল না। কিন্তু ওয়ানডেতে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ তাদের সাফল্যের ধারাটা টেনে নেয় টি-২০তেও। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানকে হারিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ। এই পারফরম্যান্সই প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়। আর আইসিসি তো বাংলাদেশকে গোনায়ই ধরেনি। তাই এশিয়া কাপের ফাইনালের দিন বাংলাদেশের প্র্যাকটিস ম্যাচ ছিল। এশিয়া কাপের রানার্স আপ হলেও বাংলাদেশকে বিশ্বকাপের মূল পর্বে যেতে হয় বাছাই পর্ব পেরিয়ে। কিন্তু বাছাই পর্ব খেলতে গিয়েই ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। হল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তাসকিন আর আরাফাত সানির বোলিং নিয়ে রিপোর্ট করেন আম্পায়াররা। পরীক্ষা শেষে আইসিসি দুজনকেই নিষিদ্ধ করে। টুর্নামেন্টের মাঝখানে এমন পদক্ষেপে অনেকেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুজে পান। দলের মনোবলে দারুণ ধাক্কা লাগে। সেই ভাঙ্গা মনোবলের বাংলাদেশও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে ফাইট দিয়েছে, তা আমাদের গর্বিত করে। হাফ চান্সগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে, ফিল্ডিংটা আরেকটু ভালো হলে সেই ম্যাচটা আমরা জিততে পারতাম। আর তারপর ভারতের বিপক্ষে এই ক্ল্যাসিক। এক রানের পরাজয় বলে কষ্টটা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ শক্তিশালী ভারতকে যেভাবে নাকানি চুবানি খাইয়েছে, তা দেখার আনন্দই অন্যরকম। ভারতের বিশ্বখ্যাত ব্যাটিং ২০ ওভারে তুলতে পেরেছিল মাত্র ১৪৬! সৌম্য সরকার টুর্নামেন্টে যে দুটি ক্যাচ ধরেছেন তা ক্রিকেটপ্রেমীদের উদ্বেলিত করবে অনেকদিন। আইসিসির এতসব ষড়যন্ত্রের পরও ক্রিকেটাররা আমাদেরও মাথা নিচু করেনি। আমরা তোমাদের নিয়ে গর্বিত।

আমি জানি। তবু আজকের লেখাটা শেষ করছি আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারার একটি পুরোনো স্ট্যাটাস দিয়ে। ২০১২ সালের ২৩ মার্চ এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২ রানে হেরে যাওয়ার পর তিনি লিখেছেন-‘I felt very sad seeing the people and players criying. Could be either ways, Bangladesh lost. But won the hearts of million people. In fact they won everything except the cup. Be aware world. Bangladesh is the new terror!’

চার বছর পরও তার স্ট্যাটাসটি সমান প্রাসঙ্গিক। ব্রায়ান লারা চার বছর আগে যেটি বুঝেছিলেন, আজ সেটা বুঝছে গোটা বিশ্ব। সামনে আরও বুঝবে।

লেখক:  অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

ইমেল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ