X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

রাষ্ট্রধর্ম

তসলিমা নাসরিন
০৩ এপ্রিল ২০১৬, ১২:৩৪আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০১৬, ১২:৪৬

tasleemaএকটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের কি ধর্ম থাকে? এর উত্তর, আমরা সকলেই জানি যে, না। কী কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র, আমি জানি না। ধর্মভিত্তিক আইন থাকলেও সে রাষ্ট্রকে সেক্যুলার বলার কোনও যুক্তি নেই। বাংলাদেশের বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার-- ইত্যাদি পারিবারিক আইন এখনও ধর্মভিত্তিক। প্রধানমন্ত্রী, আশা করি, বাংলাদেশের মতো একটি ইসলামী রাষ্ট্রকে সেক্যুলার আখ্যা দিয়ে আর লোক হাসাবেন না।
২০১১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট সরকারের কাছে জানতে  চেয়েছিলেন কেন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী -- যে সংশোধনী বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছে, সেটি অবৈধ বলে ঘোষিত হবে না। সেই একই সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে রায় দিয়েছেন।
বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষের ধর্ম ইসলাম। রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম না থাকলেও নব্বই ভাগ মুসলমানের ধর্ম ইসলামই থাকবে।
কিন্তু অসম্ভব আত্মবিশ্বাসহীন এবং দুর্বলচিত্ত হলেই মানুষ নিজের ধর্মটিকে গ্রহণ করার জন্য রাষ্ট্রকে বাধ্য করে!
মনে আছে বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্মটির জন্ম কী করে হয়েছিল।  রাষ্ট্রপতি এরশাদ  জনগণের ‘এরশাদ হঠাও’ আন্দোলনের চাপে পারলৌকিক মুলো  ঝুলিয়েছিলেন সামনে। হ্যাঁ, সংবিধানে নতুন একটি জিনিস তিনি বলা নেই কওয়া নেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, জিনিসটির নাম রাষ্ট্রধর্ম। তখন কেউ কি দাবি করেছিল, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা চাই?
আমি যতদূর জানি, কেউ করেনি। দেশে কি মুসলমানদের ধর্ম পালনে কিছু অসুবিধে হচ্ছিল যে রাষ্ট্রধর্ম না হলে তাদের আর চলছিল না? তাও নয়, খুব চলছিল, বেশ চলছিল। বহাল তবিয়তেই ছিল মুসলমানরা। মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ছিল। যত্রতত্র লোক ঠকানোর পীর ফকিরও গজাচ্ছিল। এরশাদের তখন ধর্মের ঢোল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ার কোনও দরকার ছিল না। রাষ্ট্রের কি কোনও ধর্মের প্রয়োজন হয়? মানুষের না হয় হয়, কিন্তু রাষ্ট্র কি কোনও মানুষ? রাষ্ট্র তো সব ধর্মের সব সংস্কৃতির সব ভাষার মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। রাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষ না হয়, রাষ্ট্র যদি অনেকগুলো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের পক্ষ নেয়, তবে সেই রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে বিরোধ আর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। অমুসলমানরা নিরাপত্তার অভাবে ভোগে। সভ্যতার দিকে যেতে হলে যে প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে হয়, তা হলো রাষ্ট্র আর ধর্ম পৃথক করা। সভ্য দেশগুলোয় তাই হয়েছে। যে যুগে ধর্ম ছিল রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র, সে যুগকে বলা হয় অন্ধকার যুগ। অন্ধকার যুগে লক্ষ-লক্ষ মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। অন্ধকার যুগে মানুষের বাক-স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। এরশাদ নিজের গদি বাঁচাতে নানা রকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন, তরী ডুবছে দেখে ইসলামকে আঁকড়ে ধরে কূলে ভিড়তে চেয়েছেন। অস্ত্র আর ধর্মের ভয় দেখিয়ে তিনি চেয়েছেন তার গদি টিকিয়ে রাখবেন তিনি। সংসদ বাতিল করে নির্বাচন করেছেন, কোনও বড় দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি যেহেতু, ছোট কিছু দল আর সতন্ত্র কিছু লোক নিয়েই লোকভোলানো নির্বাচনের খেলা সেরেছেন। খেলায় জিতে দেখাতে চেয়েছিলেন তার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা কিছুমাত্র অবৈধ নয়। কিন্তু তার এই টোপ কেউ গেলেনি। ক্ষমতার লোভ এমনই লোভ যে আন্দোলনের ভূমিকম্প যখন তার গদি নাড়িয়ে দিচ্ছে, খুঁটি আঁকড়ে ধরার মতো করে তিনি রাষ্ট্রধর্ম আঁকড়ে ধরলেন। জনগণের নাকের ওপর পরলৌকিক মুলো ঝুলিয়ে দিলেন। এবার যাবে কোথায় ধর্মভীরুর দল! বিরোধী দলগুলো জোট বেঁধেছে, নানারকম সাংস্কৃতিক দলও জোট বেঁধেছে শহরে গ্রামে সবখানে। এরশাদ-বিরোধী রাজনৈতিক জোট থেকে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে খুব যে কথা বলা হচ্ছে, তা নয়। কারণ ইসলামকে আমন্ত্রণ না জানালেও, ইসলাম এমন এক জিনিস, একবার কোথাও এসে বসলে, সে বসা অবৈধ হোক, ইসলামকে বিদেয় করার বুকের পাটা সবার থাকে না। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীরাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর। হাতে গোণা কিছু সাহিত্যিক সাংবাদিক রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন, এটুকুই। এর বেশি উচ্চবাচ্য ছিল না।
একাত্তরে বাঙালি মুসলমান অত্যাচারী অবাঙালি মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রমাণ করেছে মুসলমান হলেই এক সঙ্গে বাস করা যায় না। একাত্তরে বাঙালিরা প্রমাণ করেছে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ ছিল সম্পূর্ণ ভুল একটি সিদ্ধান্ত। একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালির স্বপ্ন ছিল অবাঙালি মুসলমানদের বিদেয় করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালবেসে বাংলা নামের একটি দেশ গড়ে তোলা। দীর্ঘ ন’মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন একটি দেশ জুটল। শেখ মুজিবুর রহমান দেশ চালাতে শুরু করলেন। একশ একটা ভুল তাঁর থাকতে পারে, নেতা হিসেবে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় হলেও রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর হাত কাঁচা হতে পারে, কিন্তু বলিষ্ঠ একটি সংবিধান তৈরি করেছিলেন, যে সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর সমাজতন্ত্র সহ ধর্মনিরপেক্ষতা স্থান পেয়েছিল। কোথায় সেই ধর্মনিরপেক্ষতা এখন! কোত্থেকে কোন এক মেজর জিয়া এসে ক্ষমতাদখল করে কোনও কারণ নেই কিছু নেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঘাড় ধরে বিদেয় করে দিলেন। জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও এক সেনানায়ক একটি চরম অন্যায় করলেন সংশোধনের নামে সংবিধানে একটি ধর্ম ঢুকিয়ে দিয়ে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশে খুব সঙ্গত কারণেই হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসী মানুষকে অথবা ধর্মে বিশ্বাস না করলেও যারা ওই ধর্মাবলম্বীদের সন্তান, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে হয়। জুন মাসের সাত তারিখ, ১৯৮৮ সাল। চমৎকার একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করার দিন। এক দুই বছর পেছনে নয়, হাজার বছর পিছিয়ে যাবার দিন।
এ সময় শেখ হাসিনাই হতে পারতেন সহায়। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছেন একাশি সালে, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়েছেন। ফিরে আসার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ---যারা জিয়াউর রহমানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি স্বাধীনতার শত্রুদের এমনকী গোলাম আযমের মতো একাত্তরের গণহত্যাকারীকে দেশে ঢোকার অনুমতি এবং অবৈধ ধর্মীয় রাজনীতিকে বৈধতা দিয়েছিলেন বলে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করেছিলেন বলে, ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বিদেয় দিয়েছিলেন বলে--- শেখ হাসিনার ওপর ভরসা করলেন। কিন্তু এই হাসিনাই এরশাদের ফাঁদে পা দিয়ে জামাতে ইসলামিকে নিয়ে নির্বাচনে যোগ দিলেন ছিয়াশি সালে। খালেদা জিয়া কিন্তু এরশাদের টোপ মোটেও গেলেননি। এরশাদ নিজের ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন, তা বুঝে হাসিনা শেষ পর্যন্ত সংসদ বর্জন করলেন কিন্তু জামাতে ইসলামির মতো দলের সঙ্গে ভিড়ে যে কালিটি তিনি লাগিয়েছেন গায়ে, তা খুব সহজে দূর হওয়ার নয়। তারপরও প্রগতিশীল মানুষের আশা তিনি ক্ষমতায় এলে সংবিধানের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ আবার পুনরুদ্ধার করতে পারেন।
শেখ হাসিনার ওপর যারা আশা করেছিলো, আজ তারা ভীষণই হতাশ। উনিশ’শ বাহাত্তরের সেক্যুলার সংবিধান তিনি ফিরিয়ে আনবেন কথা দিয়েছিলেন, কিন্তু ফিরিয়ে আনেননি। শেষ অবধি রাষ্ট্রধর্মকে সংবিধান থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ২৮ বছর আগের ক’জন বুদ্ধিজীবী যে মামলা করেছিলেন, সেটারই রায় ঘোষিত হলো, সুপ্রিমকোর্ট বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম থাকছে।
রাষ্ট্রধর্ম থাকা মানে রাষ্ট্রের অচিরে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া, যে ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামই হবে একমাত্র আইন! আল্লাহর আইন বা শরিয়া আইন না রেখে বিধর্মীদের তৈরি করা আইন বহাল রাখা মানে ইসলামকে অসম্মান করা। আমার বিশ্বাস আমি বেঁচে থাকতে দেখে যেতে পারবো, বাংলাদেশে ইসলামী আইন কায়েম হয়েছে। 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যারা দেশের অর্থনীতিকে খেলো মনে করে, তাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত: আদালত
যারা দেশের অর্থনীতিকে খেলো মনে করে, তাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত: আদালত
দোয়া চেয়ে আইপিএল খেলতে গেলেন মোস্তাফিজ
দোয়া চেয়ে আইপিএল খেলতে গেলেন মোস্তাফিজ
‘চোখের পানি ফেলে বাজার থেকে ফিরতে হয়’
‘চোখের পানি ফেলে বাজার থেকে ফিরতে হয়’
ওয়ালটন ফ্রিজ কিনে মিলিয়নিয়ার হলেন কুমিল্লার হুমায়ুন
ওয়ালটন ফ্রিজ কিনে মিলিয়নিয়ার হলেন কুমিল্লার হুমায়ুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ