X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংকট ও নাগরিক সমাজের দায়

চিররঞ্জন সরকার
০৭ এপ্রিল ২০১৬, ১৮:৫২আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০১৬, ১৮:৫৪

চিররঞ্জন সরকারআমাদের দেশে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না আসা, সামাজিক অবক্ষয়, সামজিক নীতিবোধ বা ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা না হওয়ার জন্য শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে না ওঠাকে অনেকে কারণ হিসেবে দেখেন।
আমাদের দেশে শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে না ওঠার পেছনে অনেক কারণের কথা ভাবা যায়। প্রথমত, অস্বীকার করার উপায় নেই, নাগরিক সমাজের বিদ্বজ্জনরাই মানোসিকভাবে ‘আমরা-ওরা’-য় বিভক্ত। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের মেঠোকর্মীর চেতনায় অনুপ্রাণিত। আর এটা সত্যি যে, মনে দলীয় আনুগত্যবোধ কাজ করলে নাগরিক সমাজকে শক্তিশালী করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, নাগরিক সমাজ সাধারণত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, গণহত্যা, ধর্ষণ, গুলিচালনার মতো জ্বলন্ত বিষয়গুলো নিয়েই প্রতিবাদ-আন্দোলনে শামিল হয়। ক্ষুধাজনিত কারণে মৃত্যু, চাষীদের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, নারী নির্যাতন, বেকারত্ব, নিরাপদ পানীয় জলের চাহিদা, চিকিৎসা সমস্যা ইত্যাদি নানা ধরনের জনস্বার্থ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধানের দাবি নিয়ে নাগরিক সমাজকে প্রবল শক্তিতে পথে নামতে তেমন দেখা যায় না। জনজাতি-আদিবাসী-প্রান্তিকবর্গের মানুষদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার বিরুদ্ধে ও আর্থিক, সামাজিক দাবিদাওয়া নিয়েই বা শহুরে বুদ্ধিজীবী নাগরিক সমাজ তেমন সক্রিয় কোথায়? মাঝেমধ্যে তারা গলা উচ্চকিত করেন বটে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হওয়ার আগেই তাদের গলা মিইয়ে যায়। অনেক সময় শুধু রাজনৈতিক স্বার্থেই নাগরিক সমাজ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর  বঞ্চনা ও অধিকার নিয়ে সরব হয়। তারপর প্রয়োজনে আবার নীরবও হয়ে যায়।
তৃতীয়ত, সরকার বদলের পর ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় নাগরিক সমাজের একাংশ প্রতিবাদী চরিত্র খুইয়ে জনগণের চোখে অবিশ্বস্ত হয়ে পড়ে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও যে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির কাছে মাথা নুইয়ে সরকারের অনুরাগভাজন হতে চান, এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো আমরা বিগত সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েই দেখেছি। সে দিন এই সমাজের তথাকথিত দিকপালদের অনেকেই দিকভ্রান্ত হয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের তৎপরতায় শামিল হয়েছিলেন। কেউ বা নেপথ্যে থেকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ‘মাইনাস’ করার ভূমিকাও পালন করেছিলেন। অনেকে আবার করে দু’নৌকায় পা রেখে চলেছিলেন।
সমাজে এই ধরনের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হলে কোনওমতেই শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। গত প্রায় চার দশক ধরে ধরে এই ধরনের দৃষ্টান্তের ধারাবাহিকতাই লক্ষ করা যাচ্ছে আমাদের সমাজে।
নাগরিক সমাজের যুগপৎ গভীর পাণ্ডিত্য ও উন্নাসিকতায় সাধারণ মানুষ তাদের সন্দেহেরে চোখে দেখেন। তারা কখন যে কোন ইস্যুতে সরব হবেন, আবার কোন ইস্যুতে নীরব ভূমিকা পালন করবেন, সেটা অনুমান করা মুশকিল। তাদের দাবি-দাওয়ায় খেটে-খাওয়া মানুষ, কৃষক-মজুর, ভাগচাষিদের স্বার্থ বড় বেশি প্রতিফিলিত হতে দেখা যায় না। তাই তাদের মতামত আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।
আমাদের দেশে স্পষ্ট দুটি শিবিরে নাগরিকরা বিভক্ত (এই নাগরিকরা ‘বুদ্ধিজীবী’, ‘সুশীল সমাজ’, ‘নাগরিক সমাজ’, ‘বিদ্বজ্জন’, ‘বিশিষ্ট’ ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত)। আমাদের দেশে নাগরিক সমাজও ঠিক দলীয় রাজনীতির ঢঙে যেভাবে ‘আমরা-ওরা’য় বিভক্ত হয়ে নিজেরে মত প্রকাশ করে, তখন বোঝা যায়, এখনও এই পোড়া বাংলায় দলই স্বর্গ, দলই ধর্ম, দলই ‘পরমং তপঃ’।
রাজনীতি-বিমুখতা, বা অ-রাজনীতির কিন্তু অন্য জিনিস। আমাদের দেশে অনেকে আবার ‘রাজনীতি’ ও ‘দলীয় পরিচয়তা’কে সমার্থক ভাবেন, বা ‘দলীয় রাজনীতি’কেই রাজনীতির একমাত্র রূপ বলে ধরে নেন। তারা ভুলে যান যে ‘রাজনীতি’ কথাটির ব্যাপ্তি অনেক বড়। জীবনের পরতে পরতে— ব্যক্তিগত, পারিবারিক থেকে সামাজিক, কর্মক্ষেত্রীয়, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রেই তা একান্তভাবে আমাদের জড়িয়ে আছে। সোজা কথায়, জীবনের প্রতিটি স্তরেই আছে ক্ষমতার অস্তিত্ব ও তা প্রয়োগের সংগঠন এবং কলাকৌশল। জীবনের বহুস্তরের ক্ষমতাবানরা আমাদের কাজকর্ম, আচরণ (এমনকি চিন্তাভাবনা) অনুমোদন বা অননুমোদন করেন, তাদের প্রয়োজন মতো আমাদের গড়েপিটে অনুগত বানাতে চান। বহু ক্ষেত্রে আমরা ক্ষমতার অধীন, আবার অনেক সময়েই আমাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সে ‘অন্যদের’ অধীন করে। জ্ঞানচক্ষু মেলার পর থেকেই এই ক্ষমতা-বলয়গুগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া, আপস, ফষ্টিনষ্টি, ঝগড়াঝাটি এমনকি সংগ্রাম করে আমাদের জীবন কেটে যায়।

ফলে, ‘দৈনন্দিনের রাজনীতি’ আমাদের জীবনের অঙ্গ। প্রতি দিনের ছোট-ছোট প্রতিবাদ বা সমাজ-পরিবেশের সার্বিক প্রশ্ন—সবটাই, বড় অর্থে, ‘রাজনীতি’র বিষয়। যখন মানবাধিকার বা সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু অথবা ক্রসফায়ারে মৃত্যুর বিরুদ্ধে বা তথ্যের অধিকার, কোনো বিশেষ খুন-ধর্ষণের মতো বিষয় নিয়ে পথে নামেন, যখন লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে, বা নারীপুরুষের বাইরে ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত মানুষের অধিকারের পক্ষে সরব হয়, তখন সেটা অবশ্যই রাজনীতি। ঠিক একইভাবে, নানা ভঙ্গিতে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ জ্ঞাপনও রাজনীতিই। কিন্তু ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’ হলো দলীয় রাজনীতি। দলীয় রাজনীতির ‘ভেতর দিয়ে’ই যখন বাঙালির ভুবনখানি দেখা হয়, তখন দলগুলোই হয়ে ওঠে এক নতুন ‘জাতপাত’ ব্যবস্থা। তখন কার জল ‘চল’ বা ‘অচল’ কার বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেব, বা কাকে সামাজিক ভাবে বয়কট করব, কাদের চার দিক থেকে ঘিরে রেখে ‘লাইফ হেল’ করে দেব, কাকেই বা ‘সাপের মতো’ পিটিয়ে মারব এই সব নিয়ে, ঠিক জাতপাতের রাজনীতির ঢঙেই চর্চা ও প্রয়োগ চলতে থাকে, তখন যুক্তি অস্ত যায়। ঠিক যেভাবে আবাহনী-মোহামেডান ক্লাবের সমর্থকরা কোনও যুক্তিকে ভিত্তি করে নয়, আবেগে ও (সাধারণত) বংশপরম্পরায়, তাদের পছন্দের ক্লাবকে সমর্থন করে যায়, তেমনই বাংলার দলীয় রাজনীতিতে মানুষের (বিশেষত গ্রামাঞ্চল ও মফস্বলে) গায়ে দোলনা থেকে কবর বা শ্মশান পর্যন্ত পার্টির পরিচয় দেগে দেওয়া হয়। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, সমাজ বা রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, বিবেকি নাগরিক সমাজ এই দলীয় কলুষের আবর্তে জড়িয়ে পড়বে কেন, এই বিশ্বায়ন-উত্তর অবাধ যোগাযোগের সাম্প্রতিক যুগে?

যোগাযোগ প্রযুক্তির মহাবিপ্লবে আজ ‘ঘুচে গেছে দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি’। ফলে, নগরকেন্দ্রিক গণপরিসরের ধারণাও (যেমন, প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে জন-সংলাপময় মার্কেট-চত্বর বা ‘অ্যাগোরা’, কিংবা আধুনিক কালের কফি হাউস, ফাস্টফুড শপ) আরও ব্যপ্তি পেয়েছে। হাতে একটা মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটের সুবিধাযুক্ত কম্পিউটার থাকলে মতবিনিময় বা তথ্য আদানপ্রদান করার জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় কফি হাউস, ফাস্টফুডের দোকানে হাজিরা দেওয়ার দরকার নেই। বিশ্বের যেকোনও প্রান্ত থেকেই তা করা সম্ভব। নতুন প্রযুক্তির পথ বেয়ে তৈরি হয়েছে কতশত মতামত, বন্ধুগোষ্ঠী বা কমিউনিটি। বহু পত্রপত্রিকা আজকাল ছাপার অক্ষরে বেরোয় না, বেরোয় ‘ইন্টারনেট’ বা অনলাইন-এ । এ কথা ঠিক, তথ্যপ্রযুক্তি একটি দু’ধার-বিশিষ্ট তলোয়ার। একটা ‘ধার’ দিয়ে ক্ষমতাবান বা রাষ্ট্র সবার ওপর নজরদারি চালাতে পারে; ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু অন্য ‘ধার’টি কাজে লাগতে পারে ক্ষমতাবানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সংগঠনের কাজেও, রাষ্ট্র কখনও তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তখন দমিত, অবহেলিত, প্রান্তিকের স্বরও মুহূর্তে প্রতিবাদের কেন্দ্রে উঠে আসতে পারে, যুক্ত করতে পারে অযুত-লক্ষ মানুষকে। তখন ‘নাগরিক সমাজ’ ও ‘নেট’-ব্যবহারকারী নাগরিকরা, বা ‘নেটিজেন’রা (যারা সংখ্যায় ক্রমবর্ধমান) মিলে যান। বড় গণমাধ্যমও  এই প্রতিবাদকে অবজ্ঞা করতে পারে না। ক্রমে সাধারণ জনসমাজ তাতে যোগ দেয়। তখন প্রতিবাদের জনজোয়ার ক্ষমতার সাঁকো নাড়িয়ে দিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের গণআন্দোলনের কথা কিংবা রাজধানীতে ফি-বৃদ্ধির প্রতিবাদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে আমরা দেখেছি, জেদে, প্রতিবাদে অকুতোভয় হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর মুখ। যাদের পুলিশ, লাঠি, কাদানে গ্যাসে থামানো যায়নি। আজ থেকে পাঁচ-ছয় বছর আগে, পেছনে শক্তিশালী সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা না থাকলে প্রান্তিক কোনও ঘটনায় এমন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়া সামাজিক প্রতিবাদ বা আন্দোলনের কথা ভাবাও যেত না।

কিন্তু কথা হলো, পাবলিক স্পেসের (জনপরিসরের) এই বিপুল ব্যপ্তি ও শক্তির যুগেও কেন আমাদের নাগরিক সমাজ তার নিজের শক্তিকে, আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যকে চিনবে না? দলীয় সংকীর্ণতার কুৎসিত বিভাজনে কেন সে নিজেকে জড়াবে? মেষশাবকদের ভিড়ে মিশে থাকা সিংহশিশুটির আজ বোধহয় একখানা আয়নার বড় প্রয়োজন!

আজ বিকল্প হয়ে দেখা দিয়েছে অরাজনৈতিক প্রতিবাদের আরও সংহত রূপ। রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে, আবার কোনো সমাধানও চোখের সামনে নেই। এ অবস্থায় জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার সংগঠিত নাগরিক আন্দোলনই ভরসা হতে পারে। কিন্তু সেটা যে প্রগতিশীল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য, রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার লক্ষ্যে কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর কপটতা নয়, সাধারণ মানুষের প্রকৃত ক্ষমতায়নের জন্য নাগরিকদের জেগে ওঠা!

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
বাবার সঙ্গে অভিমান করে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
বাবার সঙ্গে অভিমান করে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে শোকজ
কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে শোকজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ