X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘সূর্য দেখা যাবে না’

হারুন উর রশীদ
১১ এপ্রিল ২০১৬, ১৯:১৮আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০১৬, ১৯:৩৮

হারুন উর রশীদ গুজব ছড়িয়ে অপপ্রচারের নানা কৌশল থাকে । আর এই কৌশল যে যার মতো ব্যবহার করেন। এই কৌশলে লাভের চাইতে ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে ভাবেন না কেউ। আর বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত গুজব ও অপপ্রচার ছিল জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। এই অপপ্রচারের জেরে অনেকের প্রাণ গেছে, নাশকতায় পুড়েছে অনেক সম্পদ।
শিরোনামে আমি যে তিনটি শব্দ লিখেছি তা আমার কথা নয়। তা বাঁশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্যোক্তা এস আলম গ্রুপের একটি বিজ্ঞাপনের ভাষা।
গত ৪ মে চট্টগ্রামের বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিবাদের ঘটনায় চারজন নিহত হন। আর সেই ঘটনায় এস আলম গ্রুপ তার দায় অস্বীকার এবং নিজেদের ‘নিষ্পাপ’প্রমাণের জন্য গত কয়েকদিন ধরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। এই বিজ্ঞাপন এরইমধ্যে দেশের প্রথম শ্রেণির প্রায় সব দৈনিকই প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞাপনে এস আলম গ্রুপ তাদের অবস্থান এবং দায় না থাকার সপক্ষে আট দফা কারণ উল্লেখ করেছেন। তারা যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যায়, তবে আমি মনে করি তাদের একটি কারণ ও তার মূল নিয়ে আলোচনা করলেই অনেক কিছু প্রকাশ হয়ে যাবে।
এস আলম গ্রুপ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পরিবেশিত খবরের কথা বলে জানিয়েছে, 'সুর্য দেখা যাবে না, এলাকা অন্ধকার থাকবে।' এস আলম গ্রুপের বিজ্ঞাপনের ভাষা অনুযায়ী এই গুজবের কথা নামী সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। এরকম অপপ্রচার ও গুজব নাকি ছাড়ানো হয়েছিল বাঁশখালী এলাকায়।

আরও পড়তে পারেন: বাঁশখালীর ঘটনায় বিব্রত সরকার: আহতদের হাতে হাতকড়া
এস আলম গ্রুপ এই কথিত গুজব ছাড়ানোর কথা সংবাদ মাধ্যমের বরাতে বললেও আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনও সংবাদ মাধ্যমেই এই গুজবের কথা শুনিনি বা পড়িনি। আমি দেশের বহুল প্রচারিত একটি দৈনিক থেকে সেদিনের ঘটনার বিষয়ে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
'চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে-বিপক্ষের লোকজন ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিতে দুই ভাইসহ চারজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ১১ পুলিশসহ অন্তত ১৯ জন। সোমবার বিকেলে ইউনিয়নের হাদিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পাল্টাপাল্টি সমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষে প্রাণহানির এ ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, 'বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে গ্রামবাসী পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশের গাড়িবহর আটকে দেয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধীপক্ষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ব্যাপক গুলিবিনিময় হয়। এ ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন।'

আরও পড়তে পারেন:   ‘সূর্য দেখা যাবে না’ তথাকথিত 'উন্নয়ন' বনাম মানুষ হত্যা

এই প্রতিবেদনের কেথাও বলা নেই যে, সূর্য দেখা যাবে না, এলাকা অন্ধকার থাকবে।' - এধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছিল। আমি চাইলে আরও ১০টি পত্রিকার উদ্ধৃতি দিতে পারবো যেসব প্রতিবেদনে কোথাও এস আলম গ্রুপ কথিত গুজবের কথার কোনও হদিস পাওয়া যাবে না।

আমি নিজে বাঁশখালীর ঘটনার পর স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেছি। তারা কেউই আমাকে গুজবের এই বিষয়টি বলেননি। আর এস আলমের গুজব সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের পর আবারও কথা বলেছি তাদের সঙ্গে। তারা সবাই এই কথিত গুজবের কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। ‘সূর্য দেখা যাবে না’ তাহলে আমার প্রশ্ন- এস আলম গ্রুপ কোন সংবাদ মাধ্যমে এই গুজবের কথা শুনেছেন, দেখেছেন বা পড়েছেন। তারা কি এর কোনও প্রমাণ দিতে পারবেন?
আমার ধারণা এই গুজবের কথাটি এস আলম গ্রুপের কর্তাদের 'উর্বর মস্তিস্কে'র আবিষ্কার। কারণ এই বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে তাদেরই মালিকানাধীন একটি সংবাদ মাধ্যম (বেসরকারি টিভি চ্যানেল)-এর কয়েকজন কর্মী ফেসবুক ক্যাম্পেইন শুরু করেন এই কথিত গুজব নিয়ে। সেখানে তাদের একজন ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, 'গুজব ছড়িয়ে মানুষকে উত্তেজিত করার প্র্যাকটিসটা এদেশে কার্যকর- যে কারণেই সাঈদীকে চাঁদে দেখার কথা ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামানো হয়েছিলো। এবারে গুজব ছড়ানো হয়েছিল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সূর্য উঠবে না এলাকায়। কারা এই গুজব ছড়িয়ে মানুষের লাশকে পুঁজি করেন তা আমরা জানি- আমরা জানি এই সময়ে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হলে লাভবান হবে কারা? আলোচিত বাঁশখালী এলাকাটি কাদের নিয়ন্ত্রণে? নিকট অতীতে কারা বিদ্যুৎকেন্দ্র পুড়িয়েছেন- সেটাও মানুষ জানে।’
আমরা এই ব্যক্তিকে আবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জনাদশেক লোক নিয়ে 'বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার' মানব বন্ধনও করতে দেখেছি। তাই সহজেই এটি অনুমান বাস্তবতার ভিত্তি পায়। আর তা হলো- এস আলম গ্রুপই কি এই ভুয়া গুজব সৃষ্টিকারী?
আমার মনে হয় তারাই এই ভুয়া গুজবের কথা বলে বাঁশখালীর মানুষকে 'অশিক্ষিত ও কুপমণ্ডুক' বানাতে চায়। বানতে চায় জামায়াত-শিবির। সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার মতো আরেকটি গুজব নিজেরাই বানিয়ে সেখানকার সাধারণ মানুষকে ফাঁসাতে চায়।
কিন্তু তারা যা বলতে চায় তার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। ৮ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ  বলেছেন, 'বাশঁখালীর জামায়াত-বিএনপি  সরকার এবং এস আলমের পক্ষে কাজ করছে, তাদের সবাইকে টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে, সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে লুণ্ঠন প্রকল্পের প্রতিবাদ করেছেন, এই উন্নয়ন প্রকল্পে এমন সব সমস্যা আছে যা মানুষ জীবন দিয়ে হলেও প্রতিহত করতে চাচ্ছে।'
আমাদের দেশের প্রধান দৈনিকগুলো এস আলম গ্রুপের এই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করেছেন। আর তার শিরোনাম হলো - ‘ভ্রান্ত ধারণা ও বাস্তব অবস্থা’। তবে বিজ্ঞাপনটি ভ্রান্তির অবসান না ঘটিয়ে উল্টো বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। যারা বিজ্ঞাপন ছাপলো তাদের কি কোনও দায় নেই! ‘তথ্য সঠিক নয়’- এমন তথ্য দিয়ে যে বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয় তা প্রচার করা কি সংবাদ মাধ্যমের নীতিমালাবিরোধী নয়?

আরও পড়তে পারেন: হঠাৎ অস্থিতিশীলতায় বিব্রত সরকার, সন্দেহে বিএনপি-জামায়াত

বাঁশখালী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় মানুষের বিরোধিতার প্রধানত চারটি কারণ সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। ১. উচ্ছেদ আতঙ্ক ২. অধিগ্রহণ করা ভূমির মালিককে প্রকৃত দাম না দেওয়া ৩. পেশা হারানো এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা, ৪. ভূমি অধিগ্রহণের সময় প্রকৃত তথ্য গোপন করা।
এস  আলম গ্রুপ পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে একটি ফিরিস্তিও দিয়েছে বিজ্ঞাপনে। কিন্তু এত ফিরিস্তি দিলেও আসল কথা বলেনি। আর তা হলো এই প্রকল্পটি এখনও পরিবেশ ছাড়পত্রই পায়নি। পাবে সেই আশায় তারা আগেই কাজ শুরু করেছে। কিন্তু পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার আগে তারা যে কাজ শুরু করেছে সেটা বেআইনি। বেআইনিভাবে কাজ শুরু না করলে চারজনের জীবন যেত না। তাহলে এখন আমার প্রশ্ন চারজন মানুষের জীবন কেড়ে নেয়াওর দায় কার? আর একটি তথ্য জানিয়ে রাখি, ওই এলাকায় কোনও পরিবেশ সমীক্ষাই হয়নি। তাহলে পরিবেশবান্ধব হওয়ার দাবি কীভাবে করে এস আলম গ্রুপ।
শেষ করছি এস আলম গ্রুপের বিজ্ঞাপনের আরেকটি বাক্য দিয়ে। তারা বলছে, 'কোনওভাবেই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকার পরও নিহতদের পরিবারের প্রতি রয়েছে আমাদের সমবেদনা। প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপুরণ দেওয়া হবে তাড়াতাড়ি।'

২০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে বিজ্ঞাপন, 'জীবনের দাম' অন্তর্ভূক্ত আছে বলেই মনে হয়। ব্যবসা করতে গেলে এসব খরচের মধ্যেই রাখা হয়।

কিন্তু এটাকে কি এস আলম গ্রুপের ‘ মহানুভবতা’ বলবো না 'গরু মেরে জুতা দান'-এর সঙ্গে তুলনা করবো? পাঠক, আপনিই বিবেচনা করুন। 

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ