যেকোনও সংগ্রামেরই আলাদা মূল্য আছে। প্রতিবাদ-আন্দোলন-সংগ্রাম-লড়াই ছাড়া সমাজ এগোয় না। কোনও কিছু অর্জন করা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়া অন্য সব সংগ্রামকে ইতিহাস থেকে সচেতনভাবে বাদ রাখার বা তুচ্ছ করে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। ইতিহাস নির্মাণে কিন্তু বিভিন্ন রকমের সশস্ত্র সংগ্রামের ভূমিকাও রয়েছে। আঠারো শতকের কৃষকবিদ্রোহ, যা খ্যাত হয়েছিল ‘সন্ন্যাসী-ফকির’ বিদ্রোহ হিসেবে, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, হায়দার আলি-টিপু সুলতানের লড়াই, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠীর সশস্ত্র লড়াই, সংগ্রামীদের আত্মত্যাগ—সবই যেন বড় ফিকে। যেন দেশটা হুট করেই একাত্তরে এসে স্বাধীন হয়ে গেছে। তারপর আজকের এই অবস্থায় উপনীত!
ইতিহাসকে নিজেদের ইচ্ছেমতো সাজিয়ে নেওয়ার প্রবণতা আমাদের দেশে প্রবল। আর এটাও সত্য যে, ক্ষমতায় থাকা মুখগুলো কমবেশি একই রকমের হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কী ঘটেছিল, কারা ষড়যন্ত্র করেছিলেন, কারা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিলেন—সে ব্যাপারে যে যার নিজের মতো ব্যাখ্যা দেন। ইতিহাস রচনা করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু হত্যা, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতায় আরোহণ, জিয়ার শাসনকাল, নানা ধরনের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা, এই অভ্যুত্থানের সূত্র ধরে পাইকারি হারে মুক্তিযোদ্ধা-সেনা হত্যা, ক্যু, পাল্টা ক্যু হয়ে এরশাদ, এরশাদের স্বৈরশাসনের এক দশক, তার বিরুদ্ধে লড়াই, অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে এরশাদের পতন। এরশাদের দোসরদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে প্রধান দুই গণতান্ত্রিক দলে পুনর্বাসিত। আওয়ামী লীগ-বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সেনাশাসিত সরকার, বোমা, জঙ্গি, হত্যা, ষড়যন্ত্র, গুম—সব মিলিয়ে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চলছে গত আড়াই দশক ধরে।
এই সময়ে নারী, সংখ্যালঘু, সাংবাদিক, রাজনৈতিককর্মী, ছাত্র, প্রতিবাদকারী গণহারে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রতিবাদ, দলন, দমন-পীড়ন-নির্যাতন এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, এখন প্রতিবাদী মুখগুলোও কেমন পাংশু হয়ে গেছে। প্রতিবাদের স্বরগুলো হ্রস্ব হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখছে একের পর এক মুক্তবুদ্ধির মানুষের লাশ হওয়া। ধর্মীয় লেবাসধারী হিংস্র হায়েনার চাপাতির কোপে লাগাতার নিরীহ নাগরিকের রক্ত ঝরে পড়ার দৃশ্য। খুনিদের শায়েস্তা করতে ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতার ষোলকলা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নানাবিধ সব কর্মকাণ্ড। কত রকমের ফিরিস্তি, কত রকমের জোট, হরেক রঙের প্রতিশ্রুতি।আমরা দেখেছি কী ভাবে, কী অনিবার্য অসহায়তার সঙ্গে শুভবুদ্ধি জোট বাঁধছে দুর্বুদ্ধির সঙ্গে। গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিক-বেঠিকের সীমারেখা। আর নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ জোট বেঁধেছে নীরবতার সঙ্গে। আর এই ফাঁকে সুন্দরবনবিনাশী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো গণবিরোধী কাজ সরকার করছে বিনা বাধায়!
এই রকম একটা দেশ কি আমাদের প্রাপ্য ছিল? স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, শাসক দলের নেতানেত্রীরা জোট বেঁধেছেন আকণ্ঠ লোভের সঙ্গে। স্টাবলিস্টমেন্টের সঙ্গে। লুটপাট হচ্ছে, বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি হচ্ছে, স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের নামে প্রহসন হচ্ছে, নানা ফিকিরে ক্ষমতাসীন দল সমর্থক প্রার্থীদের জয়ী করে আনা হচ্ছে। বেফাঁস মন্তব্যের কারণে মন্ত্রীরা দণ্ডিত হচ্ছেন। এরপরও তারা বুক ফুলিয়ে চলছেন, কথা বলছেন। অর্থাৎ, নিজেকে সংশোধনের কোন উদ্যোগ নেই, নির্দোষ প্রমাণ করার প্রচেষ্টা নেই, এতটুকু বিবেকের তাড়না নেই, আছে শুধু ক্ষমতায় থাকার উদগ্র বাসনা। যেকোনও মূল্যে ক্ষমতায় থাকাটাই যেন ক্ষমতাসীনদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। কিছু বললেই বলা হয়, আমরা ক্ষমতায় না থাকলে এর চেয়েও খারাপ হতে পারত। কথা ঠিক, বিরোধীদের যা চরিত্র, তাতে এই কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও ভিত্তি নেই। ক্ষমতায় না থেকেই তারা গোটা জাতিকে যতটা জ্বালিয়েছে, আন্দোলনের নামে যেভাবে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, তাতে তাদের সর্বনাশ কামনা করা ছাড়া আর কি-ই করার আছে সাধারণের?
একদা যারা সজাগ, সতর্ক, সরব ছিল, তারা সচেতনভাবে জোট বাঁধছেন ‘নীরবতা’র সঙ্গে! যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না! আসলে আমাদের মতো নাগরিকদের নিরপেক্ষতার মুখোশটাও খসে পড়েছে। আজ মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, বিএনপির নৈরাজ্যমুখী ভ্রষ্ট রাজনীতি নিয়েই শুধু নয়, প্রশ্ন করতে পারতাম ক্ষমতাসীনদের নীতিহীনতা আর ব্যর্থতা নিয়েও। সমালোচনা করতে পারতাম ‘যা হচ্ছে, তা ভালোর জন্যই হচ্ছে’, এমন মনোভাবের!
চরম নৈরাজ্য ও নীতিহীনতা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের আপসকামিতা ও চরম ব্যর্থতা মানুষকে নির্বাক করে তুলছে। নতুন প্রজন্ম চার দিকের নানা রকম নৈরাজ্য দেখে ফেসবুক বা সামাজিক গণমাধ্যমে নানান মজার ছড়া আর কার্টুন এঁকে একে-অন্যকে পাঠিয়ে, হেঁসে বা রসিকতা করে নিজেদের ভুলিয়ে রাখছেন। তারা জোট বেঁধেছেন এক হতাশার জীর্ণ পরিহাসের সঙ্গে। আমাদের চিন্তাভাবনা, ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো ‘বামন-আকার’ ধারণ করেছে।
ইউরোপে একটা সময়ে শেক্সপিয়রের নাটকের সংলাপকে, ঘটনাবলিকে, চরিত্রদের আক্রমণ করা হয়েছিল এই বলে যে, তারা ‘অস্বাভাবিক’, তাদের যাবতীয় ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড সাধারণের বোধবুদ্ধির বাইরে। মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল, পুঁজিবাদী সভ্যতা মানুষকে ছাঁচে ঢালা বস্তু হিসেবেই দেখতে চায়। তাই, শেক্সপিয়রের নাটকের চরিত্ররা যখন তাদের বিশাল ক্ষমতা, পাপ, ভালোবাসা, রাগ, অভিমান, যন্ত্রণা নিয়ে মঞ্চে আসে, তখন বুর্জোয়া শ্রেণির মনে হয় চরিত্রগুলো বড় অস্বাভাবিক।
পৃথিবীটা বদলে গেছে। বিশ্বজুড়ে একটা বৃহৎ স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে। বদলে গেছে অনেক কিছু। প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি, বিশ্বায়ন, কিছুই মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকাকে নির্ভরতা দিতে পারেনি; উল্টো কঠিনতর করেছে। আর আমাদের দেশে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর অদৃশ্য প্রভাব, বৃহৎ দুই দলের খেয়োখেয়ি, এখন একদলের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব সবক্ষেত্রেই তৈরি করেছে মধ্যমেধার দাপট। স্বাধীনতার পর বামনাকৃতির যে স্বপ্ন দেখার শুরু, দিনকে দিন তা আরও ক্ষুদ্র হচ্ছে।
খরা আর হতাশা শুধু রাজনীতিতে নয়, সবখানে। খরা মেধা-মননে, খরা সংস্কৃতিতে, সংস্কৃতি চর্চায়। ‘নীল সোফাসেটে বসে মিঠে খুনসুটি’ ছেড়ে মঞ্চে আসছে না হ্যামলেট, রাজা লিয়র, ম্যাকবেথ, ওথেলো, জুলিয়াস সিজার, রোমিয়ো জুলিয়েট, কিংবা ওথেলো। এ মুহূর্তে শেক্সপিয়র চর্চা বড় বেশি প্রয়োজন, কেননা ওই চরিত্রগুলো বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। শেক্সপিয়রের বেশ কয়েকটি নাটকে এমন কিছু মানুষকে আমরা ‘জোট’ বাঁধতে দেখি, যাদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোনও মিলই নেই। কিন্তু, কিভাবে যেন ‘ঠিক-বেঠিক’-এর সীমাটা গুলিয়ে যায়, ন্যায়-নীতির বোধকে গ্রাস করে ক্ষমতালিপ্সা, প্রেমকে ঢেকে দেয় ঈর্ষা। ম্যাকবেথের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা ক্ষমতালিপ্সাকে জাগিয়ে তোলে লেডি ম্যাকবেথ। ব্রুটাস-এর স্বদেশপ্রেমকে ভুল পথে চালিত করে ক্যাসিয়াস, ওথেলোর ভেতর ইয়াগো পুরে দিতে সমর্থ হয় সর্বনাশা ঈর্ষার বিষ। আরও বহু স্তর রয়েছে চরিত্রগুলোর, যা নানাভাবে ভাবায়, প্রেরণা জোগায় সময়কে বিশ্লেষণ করতে। আমাদেরও আজ সময়কে, একইসঙ্গে নিজেদের ভূমিকাকে, বিশ্লেষণ করাটা বড় বেশি জরুরি!
তাহলে হোয়াট ইজ টু বি ডান? কী করতে হবে? এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে আমার, আপনার দায়িত্ব কী? বলা বাহুল্য, সত্য বলা এবং প্রশ্ন করা, যে প্রশ্ন অস্বস্তিতে ফেলবে ক্ষমতালোভী মানুষদের। আর এই সব কিছুর বিনিময়ে আমরা কী পাব? সুশাসন, ক্ষমতার পরিবর্তন, বিপথগামীদের সুপথে ফেরার প্রত্যাশা? হয়তো কিছুই নয়। তাহলে কী পাবেন? পাবেন সেই শক্তি ও সামর্থ্য, হেনরিক ইবসেন-এর নাটকের নায়ক ড. স্টকম্যান যা পেয়েছিলেন: ‘পৃথিবীর সবলতম মানুষ হলেন তিনি, যিনি সবচেয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকেন।’
এখানেই শেষ নয়। ইবসেন-এর কালজয়ী নাটকটিকে বহু পরে নাট্যকার আর্থার মিলার একটু ভিন্নভাবে রূপান্তর করেছিলেন। সেই নাটকের শেষে ড. স্টকম্যান উপলব্ধি করেন আরও এটি মহাসত্য: ‘তুমি সত্যের জন্য লড়াই করছ, এবং সেই কারণেই তুমি একা। এটা তোমাকে সবল করে। আর যে সবল তাকে একা হতে শিখতেই হবে।’ একা হওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে সম্ভবত একজন বিবেকবান প্রতিবাদী নাগরিকের আর কিছু পাওয়ার নেই!