X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়...

শুভ কিবরিয়া
২৪ এপ্রিল ২০১৬, ০০:১৪আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৬, ০০:১৯

Shuvo Kibriaআজ থেকে তিনবছর আগে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। আমাদের অমানবিকতার, দায়িত্বহীনতার ফলে বিশ্ব শিল্প ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্ঘটনার একটি ঘটে যায় সাভারের রানা প্লাজায়। আমাদের সস্তা শ্রমের বড় বাজার পোশাক খাতের শ্রমিকদের আমরা ঠেলে দেই এক ভয়াবহ মৃত্যুপুরিতে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল পৌনে ৯টায় সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন রানা প্লাজা ভবনটি ধসে পড়ে। রানা প্লাজা ভবনটিতে পোশাক কারখানা, ব্যাংক ও একাধিক দোকান ছিল। ভবনটিতে ফাটল থাকার কারণে ভবন না ব্যবহারের সতর্কতা থাকলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছিল। এতে ওই ভবনের বিভিন্ন তলায় অবস্থিত পাঁচটি পোশাক কারখানার শ্রমিকসহ সহস্রাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে।
সরকারি হিসাবে এ ঘটনায় নিহত হয় ১ হাজার ১৩৬ জন। আহত হয় ১ হাজার ১৬৭ জন। গুরুতর আহত ৮১ জন। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর হিসাবমতে নিখোঁজ ১৫৮ জন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি’র হিসাবমতে এ ঘটনায় পরিচয়হীন কবর দেয়া হয় ৮৩ জনের। একশন এইড বাংলাদেশের  হিসাবমতে, এই দুর্ঘটনার পর ২ হাজার ৪৩৮ জন শ্রমিককে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়, যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
আরও পড়তে পারেন: ‘ঘুরে দাঁড়াব না কেন’

দুই.
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, পোশাক কারখানার সেসব শ্রমিক, স্বেচ্ছাসেবক, উদ্ধারকর্মীদের একটা বড় অংশ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। অনেকেই হাত-পা হারিয়ে বা নানান শারীরিক মানসিক অসুস্থতার কারণে একটা ভীতিকর ট্রমার জীবনে খাবি খাচ্ছেন। অনেকেই  তাদের পরিবারের সদস্যদের আর খুঁজে পাননি, এখনও স্বজনের মৃতদেহের অপেক্ষায় আছেন। এসব হচ্ছে অপূরণীয় ক্ষতির একটা দিক।

আবার এই ঘটনার পর বাংলাদেশে পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।  দেশি ও আর্ন্তজাতিক চাপে আমাদের পোশাক শিল্প অনেক সংস্কার  ও বাধ্যবাধকতার মুখে পড়েছে। সাভার ট্রাজেডির পর ক্রেতা, দাতা সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন, পোশাক শ্রমিক সংগঠন, সরকার- এর চাপে নন-কমপ্লায়েন্স বা উন্নত কর্মপরিবেশ ছাড়া কারখানা পরিচালনা করার সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ এবং উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি গার্মেন্ট খাতের সংস্কার কাজে হাত লাগায়।

বিদেশি ক্রেতা, শ্রমিক সংগঠন, দাতা সংস্থা, সরকার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ নানান পক্ষের উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গ্রহণ করা হয় একটি ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ। এই ক্ষতিপূরণ প্যাকেজের আওতায় রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের পরিবারের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নানান মাত্রায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ পান। যে নীতি, নিয়ম বা হিসাব মেনে এই ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ নেওয়া হয় তা নিয়ে  অনেক বিতর্ক থাকলেও বাংলাদেশের শ্র্রম ইতিহাসে এই ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ একটি এক বড় ঘটনাও বটে ।

আরও পড়তে পারেন: রানা প্লাজা ধস: ৫৮ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছে

 

তিন.

এই ঘটনার পর ‘রানা প্লাজা ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠিত হয়েছে। বিভিন্ন অংশীজনের অংশগ্রহণে তৈরি হয়েছে ‘রানা প্লাজা কো-অর্ডিনেশন কমিটি’। ‘রানা প্লাজা অ্যারেঞ্জমেন্ট’ নামে তৈরি করা হয়েছে একটি সমন্বয়ী অবকাঠামো। তার মধ্য দিয়ে আলোর মুখ দেখেছে ‘রানা প্লাজা ক্লেইমস অ্যাডমিনিসট্রেশন’। নিরপেক্ষ অংশীজন হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

রানা প্লাজা ধস আমাদের পোশাক খাতকে যেমন বহুমাত্রিক সংকটে ফেলেছে ঠিক তেমনি সংকট মোকাবিলার উপায় হিসেবে পথ খুঁজে বের করার সুযোগও দিয়েছে। এসব কাজে বিদেশি ক্রেতা, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, সরকার, এনজিও, দেশি-বিদেশি ব্যাংক-প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংগঠন, সুশীল সমাজের সংশ্লিষ্টতা এসেছে। শ্রম আইন সংশোধন হয়েছে। সরকার বিপুল সংখ্যক কারখানা পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছে। গার্মেন্ট খাতের কর্মপরিবেশ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়ে নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। আমাদের গার্মেন্ট মালিকদের একটা বড় অংশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এসব বিধিনিষেধ মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

চার.

সাভার ট্রাজেডির তিন বছরের মাথায় সামগ্রিক কর্মপদ্ধতির একটা পর্যালোচনাও দরকার। কিছু কিছু বিষয়ে আরও মনোযোগ দরকার:-

১. সাভার ট্রাজেডির ক্ষতিগ্রস্থদের আর্থিক, শারীরিক মনোসামজিক ও জীবনজীবিকার পুনর্বাসনের জন্য নানা প্রতিষ্ঠান নানাভাবে ব্যবস্থা নিয়েছে। রানা প্লাজা ধসের অব্যবহিত পরে যে দুর্গতি এবং অনিশ্চিত অন্ধকারে পড়েছিল এই ঘটনার শিকার পোশাক শ্রমিকরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানারকম ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা এবং জীবন-জীবিকার সহায়তা তাদের অনেককে নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে। কিন্তু এই সব উদ্যোগের অধিকাংশই হচ্ছে সময় নির্দিষ্ট প্রকল্পভিত্তিক। প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরে এই সহায়তা কার্যক্রমের কী হবে? এইসব ক্ষতিগ্রস্তদের বড় অংশের প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক চিকিৎসা ও মনোসামজিক চিকিৎসা সহায়তা। এই চাহিদা পূরণের জন্য সরকারি উদ্যোগে একটা স্থায়ি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

২.  এই ঘটনায় আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের যারা হাত-পা হারাননি, দৃশ্যমানভাবে যাদের আঘাত সুস্পষ্ট নয়, তারা ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে কোনও স্বস্তিকর অঙ্ক পাননি। অথচ মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে নানারকম জটিলতর অসুস্থতার মধ্যে তারা পড়েছেন। রানা প্লাজা ধসের ক্ষতিগ্রস্তদের এই অংশটি একটি বিমর্ষময় অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে পড়েছে। এদের বিষয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।

৩.  অনেকের মরদেহ পাওয়া যায়নি। অনেকের মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি। দুর্ঘটনার পর যারা আর্থিক ক্ষতিপূরণ কিংবা পুনর্বাসন সহায়তা দিয়েছেন তারা সনাক্তকৃত মৃতদেহের পরিবারকেই সহায়তা দিয়েছেন। যেসব মরদেহ সনাক্ত হয়নি কিংবা যেসব মরদেহ নিখোঁজ তাদের পরিবার কোনওরকম আর্থিক সহায়তা পায়নি। এদর বিষয়টিও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

৪. ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকের শরীরে স্ক্রু, মেটাল রড, পাতসহ নানাবিধ কৃত্রিম জিনিস ঢুকিয়ে তাদের অনেককেই সুস্থ ও  কর্মক্ষম করে তোলেন চিকিৎসকরা। সময়ের সংগে সংগে এই স্ক্রু, পাত, মেটাল রডও পুরনো হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এদের জন্য দরকার অধিকতর উন্নত চিকিৎসা। কারও কারও দরকার নতুন অপারেশন। কারও দরকার শরীরে বসানো স্ক্রু, পাত, মেটাল রডের পুনঃস্থাপন। এই চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু এই চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ তাদের পক্ষে করা অসম্ভব। রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত আহতদের  দীর্ঘমেয়াদে পুনঃচিকিৎসার বিষয়টি গুরুত্বসহ দেখা দরকার।

৫. রানা প্লাজা ধসে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই যারা হাত পা বা দুটোই হারিয়েছেন কিংবা ঘটনার পর অপারেশন করে হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়েছে তারা কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহার করছেন। বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কতৃক সরবরাহকৃত এসব কৃত্রিম অঙ্গ অনেকের শরীরের সঙ্গে মানানসই হয় নাই। কৃত্রিম হাতগুলো ভারী ছিল। ঘাড়ে ঝোলানোর ফিতাগুলো শরীরের সঙ্গে আঁটোসাঁটো না হওয়াতে ঘাড় ব্যথা এবং ঐ স্থানে ঘা দেখা দেয়। অনেকেই এসব ব্যবহার করে স্বস্তি পান নাই। অনেকের ক্ষেত্রে এসব অব্যবহৃতও থেকেছে। ব্যবহার উপযোগী, স্বাচ্ছন্দ্যময় কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিলে এই ক্ষতিগ্রস্তদের জীবন অনেকটা সহনীয় হতে পারে।

৬. রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য বিদেশি ক্রেতা ও ক্রেতাদের প্রতিষ্ঠান অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কারখানা পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের বেঁধে দেয়া নির্ধারিত সময়ে অনেক পোশাক কারখানা এই সংস্কার কাজ নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন করতে না পারার ফলে সেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব পোশাক কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। এসব শ্রমিকের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। এদিকটি নজরে আনা জরুরি।

 

আরও পড়তে পারেন: থামো মতিহার

 

পাঁচ.

অতীতে এরকম ছোটখাটো দুর্ঘটনায় পোশাক কারখানার মালিক, সরকার কিংবা স্বেচ্ছাসেবী নানান প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেকটা চ্যারিটি বা দাতব্যমূলক। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ পাবার বিষয়টি কেবল মুষ্টিভিক্ষা-দাতব্য বিষয় নয়, ছিল ন্যায্য অধিকার। প্রথমবারের মতো এই ঘটনাটি সংশ্লিষ্ট সকলকে দাতব্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবার সুযোগ এনে দেয়।

রানা প্লাজা ধসে যারা প্রাণ হারিয়েছেন সেই ক্ষতি অপূরণীয়। যেসব পরিবার তাদের সদস্যদের হারিয়েছেন সেই ক্ষতিপূরণ করাও বাস্তবে সম্ভব নয়। এসব সত্ত্বেও আহত ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, নানান প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় চিকিৎসা ও মনোচিকিৎসায় নতুন জীবনে ফিরে আসতে পেরেছেন। অনেকেই নতুনভাবে জীবন-জীবিকার সন্ধানে এগুতে পেরেছেন। অনেক ক্ষুব্ধতা , অনেক হতাশার মধ্যেও এই পরিবর্তন ইতিবাচক। এই ইতিবাচকতা যাতে স্থায়িত্ব পায় সে জন্য সকল অংশীজনকে তদারকি ও সহায়তা অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করা দরকার। যে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর আওতায় এই কাজগুলো সম্ভব হয়েছে তা যেন অটুট থাকে সেই চেষ্টাটাও বজায় রাখা জরুরি।

বাংলাদেশের পোশাক খাতকে মালিকদের একক বলয় থেকে বের করে একটি বহুপাক্ষিক প্রাতিষ্ঠানিক আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে এনেছে এই ঘটনা। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখাই হচ্ছে বড় কাজ। আর এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য যারা দায়ী তাদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জটিও থাকছে রাষ্ট্রের সামনে।

 

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ