X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

তিনি তো ‘নাস্তিক’ ছিলেন না!

হারুন উর রশীদ
২৫ এপ্রিল ২০১৬, ১৭:২৪আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০১৬, ০০:২৯

হারুন উর রশীদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী ছোট কাগজ বের করতেন, বাদ্যযন্ত্র শেখাতেন, চর্চা করতেন সেতার আর বাঁশি। তথ্যচিত্রও বানানোর ইচ্ছা ছিল। এখন পর্যন্ত তার ব্যাপারে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে তিনি ‘নাস্তিক’ ছিলেন তার কোনও প্রমাণ মিলছে না। বাংলাদেশে যে কাউকে ‘নাস্তিক’ বলে হত্যা করা যেন জায়েজ হয়ে গেছে। তাহলে অধ্যাপককে কেন হত্যা করা হলো?
অধ্যাপককে হত্যার পর থেকেই আমি চেষ্টা করেছি তার ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবন সম্পর্কে জানতে। তার যারা কাছের মানুষ। তার যারা প্রিয় ছাত্র, এরকম অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাতে যা জেনেছি তা হলো- তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করতেন না। নিজের ছোট কাগজ ছাড়া আর কোথাও লিখেতেনও না। ‘কোমলগান্ধার’ নামের ছোট কাগজটি তিনি প্রায় একযুগ ধরে অনিয়মিতভাবে নিজের পয়সায় প্রকাশ করে আসছিলেন। আর তাতে তার বিভাগের শিক্ষার্থীরাই প্রধানত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখতেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র রকিবুল আলম সোহান আমার পরিচিত। তিনি চার বছর ধরে ঘনিষ্ঠভাবে তার প্রিয় অধ্যাপকের নানা কাজে অংশ নিয়েছেন। সোহানের সঙ্গে আমি ঢাকা থেকে কয়েক দফা টেলিফোনে কথা বলেছি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জানতে চেয়েছি। জানতে চেয়েছি তিনি ফেসবুক ব্যবহার করতেন কিনা। সোহান জানিয়েছেন, ‘স্যারের একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল। তা আমাদেরই খুলে দেওয়া। তিনি সেটা ব্যবহার করতেন না। এমনকি কম্পিউটার ব্যবহারেও তিনি দক্ষ ছিলেন না। আমরাই তার কম্পিউটারের অনেক কাজ করে দিতাম।’
রাজনীতিবিমুখ এই মানুষটি ছাত্রদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। বিভাগের খেলাধুলায় ছিল তার আগ্রহ। তিনি সবার আগে সবাইকে নিয়ে মাঠে যেতেন। এমনকি তার গ্রামের বাড়ি বাগমারায় প্রতিবছর ঘোড়দৌরেরও আয়োজন করতেন। আর পুরস্কারও দিতেন নিজের গাঁটের পয়সা থেকে।
তার ছোট কাগজ কোমলগান্ধার-এ কী থাকত? সোহানের জবাব, একদমই নির্দোষ লেখালেখি। স্যার রাজনৈতিক লেখাও ছাপতেন না। আমরা তার প্রগতিশীলতা বুঝতে পেরেছি, কিন্তু তার রাজনৈতিক ঝোঁক কখনও বুঝতে পারিনি। তিনি এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথাও বলতেন না। স্যার তার ছোট কাগজে আমাদের লেখা ছাপতেন। নিজেও লিখতেন। আর লেখার বিষয় ছিল শিল্প-সাহিত্য, কবিতা প্রভৃতি।

আরও পড়তে পারেন: থামো মতিহার


বিশ্ববাংলা নামের যে সাংস্কৃতিক সংগঠনটি তিনি চালাতেন, তার অফিস ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অফিস কক্ষেই। নিজের ২২৭ নম্বর কক্ষ ছেড়ে দিয়েছিলেন বাদ্যযন্ত্র চর্চা আর কবিতা চর্চার জন্য। তিনি নিজেও ভালো সেতার বাজাতেন। চর্চা ছিল বাঁশি, ঢোল- তবলা আর হারমোনিয়ামের। সবমিলিয়ে তিনি একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তুলেছিলেন।
অধ্যাপক রেজাউল করিমের শালবনের বাড়িতে পড়ে আছে সেতার। মেঝেতে কাপড়ে ঢাকা হারমোনিয়াম আর একটি একতারা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লোকজ সাংস্কৃতিক চর্চার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। খাটের সামনে সেলফ ভর্তি নানা ধরনের বই।

তিনি লোকসাহিত্যও সংগ্রহ করতেন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে। ইচ্ছে ছিল এর ডকুমেন্টেশন করবেন। এজন্য একটি ভিডিও ক্যামেরাও কিনেছিলেন সম্প্রতি।
অধ্যাপক শালবন এলকায় থাকলেও তার গ্রামের বাড়ি বাগমাড়া। সেখানে ছয় মাস আগে তিনি একটি গানের স্কুল করেছিলেন। একজন শিক্ষকও রেখেছিলেন। নিজে সেই স্কুলে যেতেন। আড্ডায় মেতে উঠতেন।

আর কিছু? তিনি কি ‘নাস্তিক’ ছিলেন? জানতে চাই সোহানের কাছে।

আরও পড়তে পারেন: নতুন ছবিটা আর বানানো হলো না অধ্যাপক রেজাউলের

সোহান তার স্যারের সঙ্গে তার গ্রামের বাড়ি বাগমারায় গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির মসজিদে কয়েক মাস আগে দেড় লাখ টাকা খরচ করে উন্নয়ন কাজ করিয়েছেন অধ্যাপক- জানালেন সোহান। তিনি এলাকার মাদ্রাসা এবং এতিম খানার একজন নিয়মিত দাতা ছিলেন।

ভাবলাম অধ্যাপক নামাজ পড়তেন কি না? তিনি কি খাঁটি মুসলমান ছিলেন? এসব প্রশ্ন করি সোহানকে। কিন্তু আর পারলাম না। একজন মানুষের ব্যাপারে এসব প্রশ্ন করতে আমার রুচিতে বাধলো। মনে হলো এসব প্রশ্ন করে নিজেকে কেন ছোট করা। মানুষকে চিনতে এই প্রশ্ন কি জরুরি?

আমাকে প্রশ্ন করতে হলো না। কেন জানি সোহান নিজে থেকেই বলতে লাগলেন, ‘স্যার নামাজ পড়তেন, রোজাও রাখতেন। জুমার নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত।’

অধ্যাপক রেজাউলকে হত্যা করা হয়েছে জঙ্গি স্টাইলে। একটি মোটরসাইকেলে করে এসে তিন দুর্বৃত্ত তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। পুলিশও তাই বলছে। আর বাংলাদেশে জঙ্গিরা একইভাবে আরও কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাদের ভাষায় তারা ‘নাস্তিকদের’ হত্যা করছে। তাদের হত্যাকাণ্ডগুলো বিশ্লেষণে চারটি বিষয় স্পষ্ট হয়:
১. হত্যাকারীদের অপারেশনের ধরণ একই- তারা মোটরসাইকেলে করে আসেন।

২.বাস্তবায়ন পদ্ধতিও এক। তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে বা গলা কেটে আবার কখনও গুলি করে হত্যা করে। ৩. তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিদেশি বা ভিন্ন ধর্মীয় চিন্তার মানুষকে হত্যা করে। ৪. তারা নাস্তিক আখ্যা দিয়ে হত্যা করে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে যাদের হত্যা করা হয়েছে, কোনও হত্যারই বিচার হয়নি। অপরাধীরা আটকও হয়নি। আর তারা একের পর এক ‘নাস্তিক’ হত্যা করে পার পেয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ‘নাস্তিক’ হত্যা যেন বৈধতা পেয়েছে।

বাংলাদেশের আইনে নাস্তিক হত্যা বৈধ কিনা আমি জানি না। আর নাস্তিক- আস্তিক নির্ধারণে বৈধ কোনও কর্তৃপক্ষ আছে কিনা তাও আমার জানা নেই। তবে সরকারের উচিৎ হবে বিষয়টি দেশের মানুষকে পরিষ্কার করা। তাহলে আমরাও স্পষ্ট বুঝতে পারব কে কী কারণে খুন হলেন। কোনও হত্যার বিচার হবে, কোনওটার হবে না। কে ‘নাস্তিক’ আর কে ‘আস্তিক’।

আরও পড়তে পারেন: ফের মোটরসাইকেলে তিন ঘাতক


কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিক তো নাস্তিক ছিলেন না। তিনি তো নামাজ পড়তেন, মসজিদ মাদ্রাসায় দান করতেন। তাহলে তাকে কেন হত্যা করা হলো?

এই প্রশ্নের জবাব পেতে আমার মনে হয় আমাদের আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। কারণ আমার ধারণা, হত্যার জন্য জঙ্গিদের নাস্তিকতার সংজ্ঞা বিস্তৃত হচ্ছে। পহেলা বৈশাখ যদি হিন্দু সংস্কৃতি হয়, ইসলামবিরোধী হয়। তাহলে বাঁশি, ঢোল, সেতার কেন হিন্দু বাদ্যযন্ত্র হবে না! গানের স্কুল কেন ইসলামবিরোধী হবে না!
ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। টার্গেট বাড়ছে। নাস্তিকতার সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত হচ্ছে। দেখবেন দেশে ক্রমেই ‘নাস্তিকের’ সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বাড়তে থাকবে লাশ। জঙ্গিরা বাড়লে আমরা কমবো। এটাইতো স্বাভাবিক।
লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ