X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
স্ত্রী মহুয়ার দাবি

আমার সামনে থেকেই চার মাস আগে মুকুলকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়

তৌহিদ জামান,যশোর ও আসাদুজ্জামান,সাতক্ষীরা
২১ জুন ২০১৬, ১৮:২১আপডেট : ২২ জুন ২০১৬, ১০:৪১

স্বামীর চেহারাটাও ভালোভাবে মনে নেই মহুয়ার। মাত্র চারদিনের সংসার ছিল তার। ভালো করে মুকুলকে বুঝে ওঠার আগেই চোখের সামনেই তাকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। সেই দেখাই যে শেষ দেখা হবে সেটা কী আর জানতেন...! আবেগের অশ্রু লুকিয়ে ফেলে চার মাস আগের কথা মনে করতে বসেন মহুয়া ।

মুকুল রানা

‘সেদিন ছিলো ২৩ ফেব্রুয়ারি। এর চারদিন আগেই মুকুল রানার সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। উনি বললেন, তার বাড়িতে (শ্বশুরবাড়ি) নিয়ে যাবেন। আমরা তৈরি হয়ে একটা ইঞ্জিনভ্যানে চড়ে জগন্নাথপুর থেকে যশোর শহরের বসুন্দিয়া বাজারে যাই। সেখানে নামা মাত্র কয়েকজন লোক ‘এই যে মুকুল’ বলে ওনার শার্টের কলার চেপে ধরে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায়। আমি দৌড়ে বাজারের একপাশে এসে একটা মোবাইল ফোনের দোকানে ঢুকি। সেখান থেকে ফোন করে বাড়িতে ঘটনাটা জানাই। সেই শেষ দেখা আমাদের। আর তার খোঁজ পাইনি। চার মাস পর খোঁজ পাইলাম তার লাশের।’

ডিবি পুলিশের দাবি করা কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত মুকুল রানার বিষয়ে এটুকু তথ্যই দিতে পেরেছেন তার বিধবা স্ত্রী মহুয়া সুলতানা পিয়ারী। এ ঘটনার পর পুলিশ তার এক ভাইকেও জঙ্গি সন্দেহে ধরে নিয়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করারও সাহস হারিয়ে ফেলেছেন তিনিসহ তাদের পুরো পরিবার। অবস্থা এমনই যে, স্বামীর পর এবার যদি ভাইয়ের কিছু ঘটে এই আশঙ্কায় স্বামীর মরা মুখটাও দেখতে যাননি তিনি।

এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মহুয়া সুলতানা পিয়ারীর সঙ্গে বিয়ে হয় সাতক্ষীরার ধুলিহর ইউনিয়নের বালুইগাছা গ্রামের আবুল কালাম আজাদের ছেলে মুকুল রানার। বিয়ের দিন বিকেলে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি যান এবং পরদিন ফের স্ত্রীসহ শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসেন। এর চারদিন পর আবারও স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পথে সাদা পোশাকের পুলিশ মুকুলকে আটক করে। এ ঘটনার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি মহুয়ার ভাই আমির হোসেন (ইঞ্জিনচালিত ভ্যানচালক) এ ঘটনায় যশোর কোতোয়ালী থানায় জিডি করেন। এরপর তারা বেশ কয়েকবার যশোর, নড়াইলসহ বিভিন্ন স্থানে মুকুলের সন্ধান করেও তার কোনও হদিস পাননি।

মহুয়া জানান, শ্বশুরবাড়ির লোকজনও তাকে অনেক খুঁজেছে বলে শ্বশুর তাকে কয়েক দফা ফোনে জানান।

মুকুল আটকের ১৭ দিন পর তার ছোট ভাই মুজিবর রহমান ঢাকায় যান ভাবির চিকিৎসা সংক্রান্ত খোঁজ-খবর নিতে। ওই সময় তাকেও পুলিশ আটক করে।

কিন্তু কী কারণে তার স্বামী ও ভাইকে পুলিশ আটক করেছে- তা এই পরিবারের কেউই বলতে পারেননি।

এক প্রশ্নের জবাবে মহুয়া ও তার মা মাহমুদা বেগম জানান, আমরা কোনও রাজনৈতিক দল করি না। গরীব মানুষ, কীভাবে সংসার চলবে এই চিন্তায় আমাদের দিন কাটে।

মুকুল রানার শ্বশুরের নাম মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস, পেশায় কৃষক। সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা মেলেনি তার।  বাড়িতে থাকা তার স্ত্রী মাহমুদা বেগম জানান, সকালেই তিনি ক্ষেতে চলে গেছেন কাজ করতে। মাহমুদা জানান, আমরা গরিব মানুষ, দিন এনে দিন খেতে হয়। তাদের তিন ছেলে, এক মেয়ে। বড় দুজন জাকির হোসেন ও আমির হোসেন আলাদা থাকেন। ছোট ছেলে মুজিবর রহমান তাদের সঙ্গে থাকতেন।

মুকুল রানার বাবা আবুল কালাম আজাদ

তিনি জানান, ছোট ছেলে মুজিবর রহমানের বসুন্দিয়া বাজারে ছোট একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকান ছিল। তাকে আটকের পর তাদের সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।

মেয়ে জামাই নিহত, তার লাশ উদ্ধার বা জানাজার বিষয়ে তেমন কোনও আগ্রহ দেখা যায়নি এই পরিবারের সদস্যদের। আপনারা কেন সাতক্ষীরায় যাননি- এমন প্রশ্নের জবাবে মহুয়ার মা মাহমুদা জানান, আমার ছোট ছেলে আটকের পর আমরা সবকিছুই হারিয়েছি। আমাদের তেমন স্বচ্ছলতা নেই যে সাতক্ষীরায় যাবো। বিষয়টি মেয়ের শ্বশুরকেও জানিয়েছি।

প্রসঙ্গত, মাহমুদা যশোরের নওয়াপাড়া কওমি আমিনিয়া মাদ্রাসায় মেশকাত (এইচএসসি সমমান) পড়ছেন।

এদিকে, মহুয়ার দাবিকে সমর্থন করেছেন তার শ্বশুর নিহত মুকুলের বাবা আবুল কালাম আজাদ। তিনিও বলেছেন, তার ছেলে মুকুলকে নববিবাহিতা স্ত্রীর সামনেই আটক করে সাদা পোশাকের পুলিশ। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে আটকের সময় ছেলের সঙ্গে থাকা বিয়ের নতুন ল্যাগেজ, ২৫ হাজার টাকা, স্বর্ণের আংটি, একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনও পুলিশ নিয়ে গেছে বলে দাবি করেন আবুল কালাম আজাদ।

মুকুলের বাবা আরও  বলেন, কিছুদিন আগে ছয় জঙ্গিকে ধরিয়ে দিতে ৫ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল সে ছবিতে আমার ছেলে মুকুল রানার পরনে যে শার্ট ছিল সেটা আমরা কখনও তাকে পরতে দেখিনি। যেদিন পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায় সেদিন তার পরনে যে শার্টটি ছিল সেটি বিয়ের সময় সাতক্ষীরার ধুলিহর বাজারের একটি দর্জির কাছ থেকে সে বানিয়ে নিয়েছিল। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পরেও তার পরিধানে ছিল একই শার্ট।

তিনি আরও বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি ধুলিহর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে তার ছেলে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এটা তিনি মানতে পারছেন না।

তিনি বলেন, কোনও অপরাধ করে থাকলে তাকে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করতে পারতো। কিন্তু  বিচার না করে তাকে ক্রসফায়ারে  হত্যা করা হয়েছে।

মুকুলের বাবা আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, আমরা কেউ জানি না আমাদের ছেলে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কিনা। যদি জড়িত হয় তাহলে যারা আমার ছেলেকে এই পথে নিয়ে এসেছে তাদের বিচার না করে কেন আমার ছেলেকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা হলো। আমি আমার ছেলেকে আর কোনওদিন ফিরে পাবো না। যারা আমার ছেলেকে এই পথে নিয়ে এসেছে তাদের বিচার দাবি করছি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, তার ছেলে মুকুলের মতো ভুল পথে গিয়ে আর কোনও বাবা-মায়ের কোল যেন খালি না হয়। এজন্য সন্তানদের ওপর নজর রাখতেও দেশের সব অভিভাবকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

প্রসঙ্গত ধুলিহর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাবু নিশ্চিত করেছেন আবুল কালাম আজাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির একজন সদস্য।

এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে লাশ গ্রহণ শেষে মঙ্গলবার সকালে তাকে সাতক্ষীরার ধুলিহর ইউনিয়নের বালুইগাছা গ্রামে নিজ বাড়িতে আনা হয়। বেলা ১১ টায় পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজন ছাড়াও গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে তাকে দাফন করা হয়। জানাজা পড়ান তার ফুফাতো ভাই হাফেজ আজহারুল ইসলাম।

নিহত মুকুল রানা ওরফে শরিফুলের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার ধুলিহর ইউনয়িনের বালুইগাছা গ্রামে। তার পিতার নাম আবুল কালাম আজাদ। মাতার নাম সখিনা বেগম।

তার বোন শারমিন সুলতানা বলেন, শরিফুল ওরফে মুকুল ২০০৮ সালে সাতক্ষীরার ধুলিহর আইডিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ব্যবসায়ী বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করে। সাতক্ষীরা ডে-নাইট কলেজ থেকে ২০১০ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে।

এর পরে ২০১০-১১ সেশনে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার দুই বছর পর ঢাকায় গিয়ে রাজউকে কাজ করতো বলে জানায় সে।

উল্লেখ্য, শনিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঢাকার খিলগায়ে মেরাদিয়া বাঁশপট্টি এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন মুকুল রানা ওরফে শরিফুল ইসলাম। নিহত হওয়ার দুদিন পর সোমবার বেলা ১১টার দিকে তার লাশ শনাক্ত করে তার স্বজনরা।

আরও পড়ুন:

পরিবার থেকে দীর্ঘদিন ‘বিচ্ছিন্ন’ ছিল মুকুল রানা
‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত যুবক শরিফুল না, মুকুল

মুকুলের স্ত্রীর বড় ভাই এবিটি নেতা মুজিবুর ঢাকায় গ্রেফতার হন এপ্রিলে

/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্যামসন-জুরেলের ব্যাটে লখনউকে সহজে হারালো রাজস্থান
স্যামসন-জুরেলের ব্যাটে লখনউকে সহজে হারালো রাজস্থান
মুগদায় তীব্র গরমে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির মৃত্যু
মুগদায় তীব্র গরমে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির মৃত্যু
কাপ্তাই হ্রদে নাব্য সংকট, ৫ উপজেলার যোগাযোগ বন্ধ
কাপ্তাই হ্রদে নাব্য সংকট, ৫ উপজেলার যোগাযোগ বন্ধ
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু