X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি রাজনৈতিক: শ্যামল কান্তি ভক্ত

তানভীর হোসেন, নারায়ণগঞ্জ
২৫ অক্টোবর ২০১৬, ১৪:৫৫আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:০৭

তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য দিতে আসেন আলোচিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কানে ধরে উঠবসের ঘটনার সূত্রপাত হিসেবে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগ উঠলেও সেটা ‘রাজনৈতিক’ বলে দাবি করেছেন ওই শিক্ষক।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা ১০ মিনিট পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য দিয়ে বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

তবে যে ছাত্রকে নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের সেই দশম শ্রেণির ছাত্র রিফাত হাসান অবশ্য ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত এবং সোমবার তদন্ত দলের কাছেও বলেছেন, ক্লাসরুমে তাকে শিক্ষক মারধর করে উল্টো আল্লাহকে নিয়ে ‘কটূক্তি’ করেছেন।

গত ১৩ মে লঞ্ছনার ঘটনার পর এমপি সেলিম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আমি কোনও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করি নাই। আমার আল্লাহকে কটূক্তি করায় একজন নাস্তিককে শাস্তি দিয়েছি।’ তবে ঘটনার পর থেকে শ্যামল কান্তি এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। সবশেষ মঙ্গলবার তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য প্রদান শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমাকে যে অপমান করা হয়েছে আপনারা দেখেছেন, আমি সেটার সুষ্ঠু বিচার চাই। ধর্ম নিয়ে কটূক্তির কোনও প্রশ্নই উঠে না। আমার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়ে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে সেটা অতিরঞ্জিত কথা। এটা একটি পলিটিক্যাল ট্রিক্সও হতে পারে বা পলিটিক্যাল পর্যায়ে চলে যেতে পারে। আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছিল সেটারও নথি আমি জমা দিয়েছি। আমাকে তদন্ত কমিটি ঘটনার সূত্রপাত থেকে শুরু করে আগে পরের আদ্যোপান্ত জানতে চেয়েছিল আমি বিশদ বর্ণনা করেছি।’

তবে তিনি তদন্ত দলের কাছে কী বলেছেন তা বিস্তারিত জানাননি। সার্কিট হাউজ থেকে বের হওয়ার পর কড়া পুলিশ প্রহরায় তাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এর আগে সকালেও পুলিশ প্রহরায় তিনি সার্কিট হাউজে আসেন।

এর আগে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে সার্কিট হাউজে আসেন ঢাকা সিএমএম আদালতের চিফ ম্যাজিস্ট্র্রেট হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা মেট্রোপলিট্রন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলাম ও গোলাম নবী।

এর আগে একই তদন্ত কমিটি সোমবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল বন্দরের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ে যে ছাত্রকে নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত সেই রিফাত হাসানসহ ১৯ জনের বক্তব্য গ্রহণ করে। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত আরও কয়েকজনের বক্তব্য গ্রহণ করা হবে।

সোমবার রিফাত তদন্ত কমিটিকে জানান, ‘৮ মে পঞ্চম পিরিয়ডে আবার হেডস্যার আমাদের রুমে আসেন। ক্যারিয়ার শিক্ষার ক্লাস চলছিল। শিক্ষক ছিলেন মোশারফ স্যার। তাকে বিদায় দিয়ে হেডস্যার নিজেই ক্লাস নিচ্ছিলেন। তখন আমার পেছনের একজন শব্দ করে হাসছিল। আমি লিখছিলাম। স্যার ডাক দিয়েছেন, বুঝতে পারিনি। আমার কাছে এসে শার্টের কলারে ধরে বললেন, তোমাকে ডাকতেছি শুনছ না? আমাকে কি হেডমাস্টার মনে হয় না? এরপর আমাকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি দিতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তলপেটে একটি ঘুষি লাগলে আমি বসে পড়ি। মা-বাবা এবং আল্লাহর নাম নিয়ে কাদঁছিলাম। তখন স্যার বলেন, কিসের আল্লাহ? আল্লাহ বলতে কিছু নাই, তোরা নাপাক, তোদের আল্লাহ নাপাক।’

এদিকে মঙ্গলবারও সার্কিট হাউজে একদল ব্যক্তি শ্যামল কান্তি ভক্ত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছেন অভিযোগ তুলে তার শাস্তি দাবিতে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে অবস্থান করেন। এছাড়া সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বন্দরের কয়েকজন চেয়ারম্যান, পূজা উদযাপন পরিষদসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের লোকজন উপস্থিত ছিলেন যাদেরকে সচরাচর এমপি সেলিম ওসমানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা মিলে। এর আগে সোমবার স্কুল মাঠে গণশুনানির সময়ও শ্যামল কান্তির শাস্তির দাবিতে এক দল লোককে দেখা যায়।

‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা’র অভিযোগে গত ১৩ মে পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কানে ধরে উঠবস করান স্থানীয় নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান। ওই ঘটনায় আদালত পরে গত ৭ আগস্ট হাইকোর্ট এক আদেশে তদন্ত করতে ঢাকা সিএমএম আদালতে একজন বিচারককে নির্দেশ দেন।

সোমবার তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য দিতে আসে স্কুলছাত্র রিফাত

ঘটনার পর অভিযোগ উঠে যে, ৮ মে স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র রিফাতকে মারধর করেন প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। ওই সময়ে শিক্ষক আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেন বলেও অভিযোগ উঠে। ওই ঘটনার জের ধরে ১৩ মে শুক্রবার সকাল ১১টায় এলাকার কয়েক হাজার নারী পুরুষ একত্রিত হয়ে স্কুলের ভেতরে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় উত্তেজিতরা শ্যামল কান্তি ভক্তকে গণপিটুনি দিয়ে তার শরীরের জামা কাপড় ছিড়ে ফেলে। পরে বিকেল ৪টায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে উপস্থিত হন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। এসময় স্থানীয় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে মারধর করাসহ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। পরে সংসদ সদস্যের নির্দেশে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত নিজের অপরাধ স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে কান ধরে মুচলেকা দেন। ওই ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে এলে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ অন্তবর্তীকালীন আদেশ দেন।

হাইকোর্টের রুল হওয়ার পর ২৯ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও বন্দর থানার ওসির প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ, যা দায়সারা বলে অসন্তোষ জানান আদালত। এরপর ৮ জুন জেলা প্রশাসক নতুন করে প্রতিবেদন দেন হাইকোর্টে। ওই ঘটনার করা জিডির পর তদন্তে অগ্রগতি আছে জানিয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ও বন্দর থানার ওসি ৬০ দিন সময় চেয়ে আবেদন করেন। আদালত তখন স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনার ঘটনায় করা জিডির তদন্তে আসা ফল হলফনামা আকারে ৪ আগস্ট আদালতে দাখিল করতে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ও বন্দর থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়। গত ৭ আগস্ট পুলিশের সেই প্রতিবেদন হাইকোর্টে পড়ে শোনায় রাষ্ট্রপক্ষ। সেদিন আদালত ওই প্রতিবেদনের আলোকে একজন বিচারককে তদন্ত করতে নির্দেশনা দেন। হাইকোর্টে আগামী ৪ নভেম্বর ওই মামলার শুনানি হবে।

এদিকে ১৩ মে ঘটনার পর ওই রাতেই শ্যামল কান্তি ভক্তকে প্রথমে বন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরদিন শহরের খানপুরে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০ মে পুলিশের পাহারায় শ্যামল কান্তি ভক্তকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। গত ৯ জুন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে রিলিজ দেওয়ার পর ওইদিন বিকেলেই তিনি নারায়ণগঞ্জ শহরের নগর খানপুরে মোকরবা সড়কের বাসায় ওঠেন। সেই থেকে শ্যামল কান্তি ভক্ত পুলিশি নিরাপত্তায় রয়েছেন।

এর আগে গত ১৪ জুলাই শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলার আবেদন করা হয়, যার মধ্যে দুটি মামলাই খারিজ করে দেয় আদালত। আদালত সূত্রে জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে গত ৮ মে ও ১৩ মে ছাত্র রিফাত হাসানকে মারধরের অভিযোগে মামলাটির (নম্বর ১১০/১৬) আবেদন করেন রিফাত হাসানের মা রিনা বেগম। অন্য মামলায় বন্দর কল্যাণদী এলাকার সামছুল হক সামছু বাদী হয়ে শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটুক্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ করেন (নম্বর ১১১/১৬)। এ দুটি মামলা খারিজ হয়ে যায়। অন্য মামলাটির আবেদন করেন বন্দর উপজেলার কল্যাণদী এলাকায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক মোর্শেদা বেগম। এটা এখন আদালতে বিচারাধীন।

/এফএস/টিএন/

আরও পড়ুন: জেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি ইসির

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা