X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সচ্ছল স্বজনদের দলে ভেড়ায় নব্য জেএমবি

দুলাল আবদুল্লাহ, রাজশাহী
২৫ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:৪৪আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০১৬, ১০:২২

নব্য জেএমবির অর্থদাতা প্রকৌশলী নাফিস আহমেদ

রাজধানীর মতিঝিলে বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) রাতে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হয় নব্য জেএমবি’র দুই সদস্য। র‌্যাবের দাবি, তারা নব্য জেএমবির অর্থদাতা নিহত আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এদের একজন নাফিস আহম্মেদ নয়ন। সে রাজশাহী গণপূর্ত অধিদফতরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী।এই নাফিস আত্মীয়তার সূত্র ধরে নব্য জেএমবির ‘আদর্শে’ উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রকৌশলী নাফিসের মতো আর্থিকভাবে সচ্ছল আত্মীয়দের নব্য জেএমবির নীতি-নির্ধারকরা দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। অর্থের যোগান পেতে নানাভাবে তাদের ‘মগজ ধোলাই’ করা হয়। আর এ ধরনের ফাঁদেই পড়েছে প্রকৌশলী নাফিস। বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী  এবং গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রগুলো তাদের অনুসন্ধানে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে বলে দাবি করেছে।

এ ব্যাপারে মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে রাজশাহী মহানগর পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম  জানান, ‘এক সময় মাদ্রাসা লাইনের ছেলেমেয়েদের মগজ ধোলাই করে দলে টানতো জেএমবি’র নীতি-নির্ধারকরা। কিন্তু পরবর্তীতে শুধু মাদ্রাসা নয়, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সন্তান এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল আত্মীয়-স্বজনদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে তারা। এমনকি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন সদস্যদেরকে তারা দলে প্রবেশ করায়।সাধারণত তারা এসব ধান্দা নিয়ে অনেকটা অগ্রসর হয়। ’

জানা গেছে, গত ১১ অক্টোবর রাজশাহী গণপূর্ত অধিদফতর কার্যালয়ের সামনে থেকে প্রকৌশলী নাফিসকে একটি মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নাফিসকে তার অফিসের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়েছে। এ নিয়ে রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া থানায় একটি মামলাও হয়। পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীরা গত ১৩ অক্টোবর মানববন্ধন করে প্রকৌশলী নাফিসের উদ্ধার দাবি করেন।

১৩ অক্টোবর রাজশাহীতে মানববন্ধন করে প্রকৌশলী নাফিসের সহকর্মীরা

১৩ অক্টোবর প্রথমে নাফিসের উদ্ধার দাবিতে রাজশাহী নগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। তবে অনুমতি না থাকায় পুলিশ সেখানে মানববন্ধন করতে বাধা দেয়। তখন সেখান থেকে সরে গিয়ে গণপূর্ত অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয় চত্বরে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির রাজশাহী জেলা সভাপতি আবুল আশরাফের সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের সঞ্চালনায় এই মানববন্ধনে বক্তারা বলেছিলেন, নগরীর বালিয়াপুকুর এলাকার বাসিন্দা উপ-সহকারী প্রকৌশলী নাফিস আহম্মেদকে তার অফিসের সামনে থেকে  অপহরণ করে নিয়ে যায় একদল দুর্বৃত্ত। তাকে ধূসর রঙের একটি নম্বর প্লেটহীন মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন তার সহকর্মীরা। মাইক্রোবাসটিকে রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর মোড়ের দিকে যেতে দেখেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী। এই অপহরণের পরপরই গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাইক্রোবাসের পিছু নেন। কিন্তু তারা বেশিদূর এগোতে পারেননি। তার আগেই অপহরণকারীরা হাওয়া হয়ে যায়।

ওই মানববন্ধনে নাফিসের মা নার্গিস আখতার বলেছিলেন, ‘তিন দিন হয়ে গেল তিনি তার সন্তানের কোনও খোঁজ পাচ্ছেন না। ছেলের সন্ধান পেতে তারা মরিয়া হয়ে আছেন। কিন্তু কেউ তার ছেলের সন্ধান দিতে পারছে না। পুলিশও তাকে উদ্ধারে কোনও তৎপরতা দেখাচ্ছে না।’

মানববন্ধনে নাফিসের বাবা আবদুল মান্নান বলেছিলেন,‘ঠিকাদারদের কোনও গ্রুপ তার ছেলেকে অপহরণে জড়িত থাকতে পারে।’

নাফিসের ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগরীর রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমান উল্লাহ জানান,‘প্রকৌশলী নাফিস অপহৃত হয়েছে এমন অভিযোগে তার থানায় মামলা হলে তিনি অনুসন্ধান শুরু করেন। কিন্তু একপর্যায়ে জানতে পারেন, নব্য জেএমবির অর্থদাতা নিখোঁজ ডা. রোকনউদ্দিন নাফিসের আত্মীয়। ডা. রোকন নব্য জেএমবির তহবিলে ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে আছেন। তার সঙ্গে স্ত্রী নাইমা আক্তার, তাদের দুই মেয়ে রেজওয়ানা রোকন ও রামিতা রোকন এবং রেজওয়ানার স্বামী সাদ কায়েসও আছেন। রেজওয়ানা ও তার স্বামী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। বড় মেয়ে ও জামাতার মাধ্যমেই ডা. রোকন উগ্রপন্থায় জড়ান বলে ধারণা করা হয়। আর ডা. রোকনের মাধ্যমে প্রকৌশলী নাফিস জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল।’

পুলিশের আরেকটি সূত্র বলছে, গত ৮ অক্টোবর ঢাকার আশুলিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে নিহত হওয়া আবদুর রহমানও প্রকৌশলী নাফিসের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। আবদুর রহমানের প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান। সে ছিল নব্য জেএমবির প্রধান। তার সাংগঠনিক নাম শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার খুমরিভুজা গ্রামে। সারোয়ার জাহান ও ডা. রোকনের মাধ্যমেই নব্য জেএমবিতে উদ্বুদ্ধ হয় প্রকৌশলী নাফিস আহমেদ।

রাজশাহী মহানগরীর বালিয়াপুকুর ছোট বটতলা এলাকায় ৯২ নম্বর দোতলা বাড়িটি প্রকৌশলী নাফিসের। মায়ের নাম অনুসারে লাল রংয়ের এ বাড়িটির নাম ‘নার্গিস কুঞ্জ’। বাড়িতে মা-বাবা ও স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে থাকতো নাফিস। পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে শুক্রবার (২১ অক্টোবর) বিকালে ওই বাড়িতে যান বাংলা ট্রিবিউনের এ প্রতিবেদক। বাড়ির প্রধান ফটকের কলিং বেলে চাপ দিলে দোতলার বারান্দা প্রায় ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি এসে পরিচয় জানতে চান। তাকে পরিচয় দিলে তিনি অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর প্রায় ৩০ বছর বয়সী এক নারী এসে ফের পরিচয় জানতে চান। তাকে পরিচয় জানানোর পরও তিনি কথা বলতে চাননি।

এরপর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাফিসের বাবা আবদুল মান্নানও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের একজন প্রকৌশলী। তিনি বাসায় তেমন একটা থাকেন না। নাফিসের একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছে সিরাজগঞ্জে। এ বাসায় নাফিস, তার মা নার্গিস আখতার, স্ত্রী শামিমা আখতার ও তাদের এক সন্তান থাকেন। মাঝে মাঝেই অচেনা মানুষের যাতায়াত ছিল বাড়িটিতে।

প্রতিবেশী আইনজীবী নার্গিস আরা জানান, ‘দেড় বছর ধরে তিনি এ এলাকায় ভাড়া আছেন। নাফিসের পরিবার কারও সঙ্গে মেশে না।’

নাইম ইসলাম নামে এক দোকানি জানান, ‘নাফিস তার বাবার একমাত্র সন্তান। গত দুবছরে নাফিস কখনও তার দোকানে আসেনি। তবে অফিসে যাওয়া-আসা এবং নামাজের সময় মসজিদে যেতে দেখতেন তাকে।’ সম্প্রতি তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।

নাফিস আহমেদ নয়নের জেএমবি সংশ্লিষ্টতা নিয়ে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ইফতে খায়ের আলম বলেন, ‘তার বিষয়ে ঢাকায় র‌্যাব বিস্তারিত বলেছে। তবে তার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য হেড অফিস থেকে আমাদের কিছু বলেনি।’

অপহৃত নাফিসকে কিভাবে মতিঝিল থেকে গ্রেফতার করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ইফতে খায়ের আলম কোনও মন্তব্য করেননি।

এ ব্যাপারে র‌্যাব-৫, রাজশাহী শিরোইল কলোনি ক্যাম্পের কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার মোবাশ্বের রহিম বলেন, ‘প্রকৌশলী নাফিস সম্পর্কে আমাদের অনুসন্ধান চলছে। র‌্যাবের প্রধান দফতর থেকে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করা হচ্ছে। জঙ্গি কানেকশনের ব্যাপারে এখনও বিস্তারিত কিছু বলা সম্ভব না। তবে কানেকশনের ব্যাপারে সত্যতা মিলেছে। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের পর তা মিডিয়াকর্মীদের জানানো হবে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদফতরের রাজশাহীর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী লতিফুল ইসলাম বলেন, ‘নাফিসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। পরে তার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। সেখান থেকে পরবর্তী নির্দেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

বিটি/এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঢামেকে কারাবন্দি হাজতির মৃত্যু
ঢামেকে কারাবন্দি হাজতির মৃত্যু
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৫
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৫
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…