আফরোজা মামুন চৌধুরী। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গান গেয়ে কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত মেলেনি কোনও স্বীকৃতি। তার প্রধান পরিচয় মুক্তিযোদ্ধা স্বামী রাজা চৌধুরীর সহধর্মিনী হিসেবে। এক সময়ের কণ্ঠযোদ্ধা আফরোজা মামুনের সময় কাটছে নওগাঁ শহরের ছেলে রুবাইয়াত চৌধুরী রাহুলের বাসায়। সেখানেই বসেই এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় এই কণ্ঠযোদ্ধার।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমেই আফরোজা মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নওগাঁর প্যারীমোহন গার্লস ও নওগাঁ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন তিনি। অল্প বয়সেই বিয়ে হয় নওগাঁর চৌধুরী পরিবারের ছেলে রাজা চৌধুরীর সঙ্গে। যুদ্ধের আগেই তাদের ঘরে জন্ম নেয় এক ছেলে ও এক মেয়ে। প্রায়াত রাজা চৌধুরী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে সুরকার, গীতিকার ও শিল্পী ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রাজশাহী বেতারে কাজ করতেন।
একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল জলিলের ডাকে দুজনেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। আব্দুল জলিল স্বাধীনতার জন্য কাজ করার লক্ষ্যে নওগাঁর প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের শপথ বাক্য পাঠ করান। সেই শপথ বাক্য অনুষ্ঠানে আফরোজা মামুন ও রাজা চৌধুরীও ছিলেন। সেই সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে এই দুজন শিল্পী অন্যান্যদের নিয়ে নওগাঁর বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণা যোগাতে গণসঙ্গীতের আয়োজন করেন।
তিনি বলেন, নওগাঁয় হানাদার বাহিনী প্রবেশ করলে এই দম্পতি তাদের গ্রামের বাড়ি পাশের গয়েশপুরে চলে যান। আব্দুল জলিলের আহ্বানে আফরোজা মামুন সপরিবারে ভারতের বালুঘাটে যান। সেখানে যোগ দেন নাট্যদলে। নাট্যদলের শিল্পীদের সঙ্গে আবার গানের টানে, দেশের টানে পথে পথে, স্টেজ শো করতে শুরু করেন। টিকিটের মাধ্যমে সেই সব শো হতো। অর্জিত অর্থ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের হাতে তুলে দিতেন তারা। স্বামী পরিবারের ব্যবহৃত একটি জিপ গাড়ি চেপে নওগাঁ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বালুর ঘাটে নিয়ে গিয়েছেন রাজা চৌধুরী। ওই গাড়িটি মুক্তিযুদ্ধেও কাজে ব্যবহৃত হয়েছিলো।
আফরোজা বলেন, ‘মালদাহ, মুর্শিদাবাদ, শিলিগুড়ি ইত্যাদি জায়গায় তাদের দল গণসঙ্গীতের শো করেছেন। নওগাঁর আরেক মুক্তিযোদ্ধা ভুটি সেই দলে কাজ করতেন। সমস্যা দেখা দিল, পাঞ্জাবিদের কামানের গোলা বালুঘাট পড়তে থাকলো।’ আফরোজা মামুন স্বামী পরিবারকে নিয়ে তখন আশ্রয় নিতে চলে যান কলকাতায়। সেখানে তাদের স্বামী-স্ত্রীর ডাক পড়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয় শিল্পী আব্দুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, লাকি আকন্দসহ সেই সময়ের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করা শিল্পীদের সঙ্গে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তাদের কাজ করতে হতো। রেকর্ডিং হয়ে গেলে একজন অচেনা মানুষ তাড়াতাড়ি তা নিয়ে চলে যেতেন। কারও সঙ্গে সেই মানুষটি কথা বলতেন না। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’ গানটি রেকর্ডিং করার সময় আফরোজা মামুনের অংশগ্রহণ ছিল সেখানে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অনেক গানই স্টুডিওতে গেয়েছেন তিনি। সেই ঐতিহাসিক কাজগুলো করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘অবশেষে এলো ১৬ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হলো। ট্রাকে করে দলবলসহ তারা চলে এলেন নওগাঁয়। চারিদিকে তখন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান আর মানুষের আনন্দ মিছিল। স্বামী রাজা চৌধুরীর সঙ্গে আবারও যোগ দিলেন রাজশাহী বেতারে। এর মধ্যে ২০০০ সালে তার স্বামী মারা যান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজশাহী বেতারে কাজ করা কালে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মুক্তিযোদ্ধার স্বৃকীতির পেতে আবেদন করেন। মারা যাওয়ার পর রাজা চৌধুরী স্বীকৃতি পেলেও আফরোজা এখনও স্বীকৃতি পাননি।
আক্ষেপ করে বলেন, ‘নওগাঁর একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী হলেও স্বামী মারা যাওয়ার পর আজ আর কেউই খোঁজ নেয় না। কোনও কিছু পাওয়ার আশায় নয়, সেদিন গান গেয়েছিলেন শুধুই দেশকে ভালোবেসে। আজও কিছুই চাই না, চাই শুধু স্বীকৃতি।’
আফরোজার ছেলে রুবাইয়াত চৌধুরী বলেন, বাবার মতো নয়, মায়ের স্বীকৃতি দেখে যেতে চান।
নওগাঁর সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল বারী বলেন, ‘আফরোজা আমাদের নওগাঁর গর্ব। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে গান গেয়ে তিনি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের তার স্বীকৃতি যত দ্রুত সম্ভব দেওয়ার দরকার।’
এ বিষয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ময়নুল হক মুকুল বলেন, ‘আফরোজার স্বীকৃতি না পাওয়াটা দুঃখজনক।’ তাকে স্বীকৃতি ও যথাযথ সম্মান দিতে দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
একদিন এই আফরোজাদের গানেই প্রানিত হয়ে লাল-সবুজের পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। আর তাই এই কন্ঠযোদ্ধার অবদানের স্বীকৃতির দাবীটুকু দ্রুতই পৌঁছুক কর্তাদের কানে প্রত্যাশা এতটুকুই নওগাঁ বাসীর।