X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয়, প্রতিবন্ধী হিসেবে টাকা পাই’

তৌহিদ জামান, যশোর
০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১১:০২আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১১:২৩

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান মোল্লা ও তার পরিবার বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার একটাই চাওয়া, মৃত্যুর আগে যেন আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এ আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন ভরসা করি, একদিন হবে। সম্মানটুকু নিয়েই শেষ নিশ্বাস ছাড়তে চাই। কথাগুলো বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় দুচোখ হারানো মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান মোল্লা। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনও সুবিধা পাইনি। বরং অন্ধ বলে টিটকারি সহ্য করতে হয়। তবে প্রতিবন্ধী হিসেবে তিন মাস অন্তর নয়শ টাকা পাই।’

মুক্তিযোদ্ধ আব্দুল মান্নান যুদ্ধের সময় ১৯ বছরের টগবগে যুবক ছিলেন। জন্ম ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি। লেখাপড়া খুব একটা জানেন না। আব্দুল মান্নান ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। বাড়ি যশোর সদরের মুনসেফপুর পশ্চিমপাড়ায়। বাবা চাকরি করতেন ইস্টার্ন জুট মিল খুলনাতে শ্রমিক হিসেবে। সে কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলের পাশেই থাকতেন।

আব্দুল মান্নান জানান, যুদ্ধে যাওয়ার আগে তার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু মথুরাপুরের মোশাররফকে নরেন্দ্রপুর এলাকার জল্লাদ আফসার নামে এক রাজাকার বন্দুকের বাট দিয়ে মারধর করে এবং   মুক্তিবাহিনীতে গেলে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। এই ঘটনাটি তার মনে ব্যাপক দাগ কাটে। এরপর মা-বাবা ও বন্ধু মোশাররফকে না জানিয়ে তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। মনে মনে শপথ নেন এই জানোয়ারদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এরপর তিনি চলে আসেন প্রশিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব মিন্টুর কাছে। সদরের একডালা-বটতলা এলাকায় তিনি তরুণ যোদ্ধা রেজা কাজী, ফরিদ, শান্তি ও আব্দুল মান্নানসহ ১৫-১৬ জনের কাছে থেকে রাইফেল চালনা থেকে শুরু করে ক্রলিং, সেফটিনেট, গ্রেনেড নিক্ষেপ ইত্যাদির প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযোদ্ধা মিন্টু এর আগে এসব বিষয়ে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং তৎকালে তিনি মুজাহিদ কোম্পানির টুআইসি ছিলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কোরেও কাজ করেছেন। এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে মান্নান ভারতে চলে যান। ভারতের বনগাঁওয়ের চাপাবাড়িয়া ট্রেনিংক্যাম্পে ছিলেন, অস্ত্রের উপর প্রশিক্ষণ নেন।

একই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন জানান, তিনি ও মান্নানসহ ১৫ জন একসঙ্গে ট্রেনিং করেছেন। ট্রেনিং শেষে আর মান্নানের সঙ্গে তার দেখা হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান জানান, ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরি। আব্বা বললেন, এখানে খুব খারাপ অবস্থা, তুই চলে যা।এরপর ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ নামে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ফের ভারতে গিয়ে আরেকদফা প্রশিক্ষণ নিই। সেখানে আমির আলী পাঠান নামে একজন প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে দুই আড়াই মাস ট্রেনিং নিই। এরপরনভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে আমাদের ১১ জনের একটি দলকে দেশে পাঠানো হয়।

আব্দুল মান্নান আরও জানান, ৬ ডিসেম্বর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন, ডেপুটি কমান্ডার চুয়াডাঙ্গার লতার নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার উথলিতে অবস্থান আমি ও বরিশালের হানিফ, নারকেলবাড়িয়ার মুসা, উথলির মান্নানসহ (২) ১১ জন যাই। উথলির একটি শালবাগান। বিকেল ৫টা থেকে পাকিস্তানিদের সঙ্গে গুলি বিনিময় হয়। এই লড়াইয়ে তাদের কারোরই বেঁচে থাকার কথা ছিল না। কমান্ডার আনোয়ারের কাছ থেকে তার দূরত্ব ছিল ৫০ গজের মতো। হঠাৎ পাকিস্তানিদের একটি গ্রেনেডের আঘাতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন কমান্ডার আনোয়ার। আর সেই সময়ই কী যেন লাগে আমার মুখমণ্ডলে। তিনি বলেন, কী যে একটা এসে লাগলো কপালে, মুখের নিচে এবং দুচোখে। খুব জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। এরপর আর কিছু মনে নেই। পরে জানতে পারি দর্শনার একটি গোপন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমাকে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর থেকে দু’চোখে আর কিছুই দেখতে পাই না। ততদিনে দেশস্বাধীন হয়ে গেছে। এর মাসখানেক পর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ (তিনিও তালিকাভুক্ত হননি, মারা গেছেন সম্প্রতি) আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেন।’

‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয়, প্রতিবন্ধী হিসেবে টাকা পাই’ ২৩ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। দুই ছেলেমেয়ে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে মাসুম বিল্লাহ (১৫) ঢাকায় দর্জির কাজ করে।

সংসার চলছে স্ত্রী রাশিদা বেগমের দৈনন্দিন মজুরির উপরে। তিনি স্থানীয় একটি পানের বরজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। মজুরি একশ টাকা। আজ ১৪-১৫ বছর ধরে তিনি সেখানে কাজ করেন। আব্দুল মান্নান বলেন, ‘খুব কষ্ট করেই সংসার চালাতে হচ্ছে।’

‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয়, প্রতিবন্ধী হিসেবে টাকা পাই’ আব্দুল মান্নান বলেন, যখন যেখানে ছিলাম তারা যে কাগজপত্র দিয়েছে, তা রেখে দিই। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হওয়ার পর আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। অনেক কাগজপত্র হারিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু নেই, তাই স্বীকৃতিও পাবো না, এমন বিশ্বাসই ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তার শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আমার আশা জাগ্রত হয়। যাচাই বাছাইতে আমার নাম তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও কেন যে বাদ পড়লো জানি না। অনেক চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারিনি। ফের হতাশা ভর করে।

এরপর ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা নতুন করে ভাবেন। তালিকা থেকে যারা বাদ পড়েছেন তাদের নিবন্ধনের ঘোষণা দেন। সংবাদ পেয়ে ওই বছরের ১৭ জুন নিবন্ধন করি। যার ডিজি নং- ৫০৫৮৮। মনে হয়েছে, এবার হয়তো আমার কপালটা খুলতে পারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা আর হওয়ার নয়।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নানের বাড়িতেই এই প্রতিবেদকের কথা হয় একই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা মো. মকবুল হোসেন, আব্দুল ওহাব মিন্টু, নওশের আলী গাজী প্রমুখের সঙ্গে।

তারা জানান, এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আব্দুল মান্নানই সবচেয়ে কষ্টের মধ্যে দিনানিপাত করছেন। বহু চেষ্টা করা হয়েছে তার নাম তালিকাভুক্ত করা জন্য। কিন্তু কী এক অজানা কারণে তার নামটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

তারা আরও জানান, শুধু মান্নান একা নন; এই এলাকাসহ আশপাশের আরও কয়েকজনের নাম নথিভুক্ত হয়নি। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে যশোর পিকনিক কর্নার (শাহাবাটি দিঘির পাড়) এলাকায় পাকসেনাদের সঙ্গে মকবুল হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়। সে লড়াইয়ে শহীদ হন গোলাম মোস্তফা মৌলভী, আব্দুল গফুর মৃধার তাদের নামও নেই তালিকায়। এছাড়া জীবিতদের মধ্যে তালিকাভুক্তি হয়নি নরেন্দ্রপুর এলাকার নওশের আলী গাজী, আব্দুস সালাম, গোপালপুর এলাকার আবুল হোসেন খোকন, কচুয়া এলাকার আব্দুল মতিন, ওয়াজেদ আলী, দেয়াপাড়ার রেজা কাজী ও ফারুক শাহী প্রমুখ।

/এমডিপি/

 

 

সম্পর্কিত
নানা আয়োজনে রাজধানীবাসীর বিজয় উদযাপন
বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা
জাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
সর্বশেষ খবর
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৫
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৫
জেলা আ.লীগ সম্পাদকের প্রতিদ্বন্দ্বী সভাপতির ছেলে, আছেন ছাত্রলীগ সম্পাদকও
উপজেলা নির্বাচনজেলা আ.লীগ সম্পাদকের প্রতিদ্বন্দ্বী সভাপতির ছেলে, আছেন ছাত্রলীগ সম্পাদকও
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…