স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪৫ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত যশোরের মণিরামপুরের ১৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাননি। বিজয়ের ৪-৫ দিন আগে রাজাকাররা মণিরামপুর উপজেলার কপালিয়া ব্রিজ সংলগ্ন খেয়া ঘাটে ১২ মুক্তিসেনাকে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। তারা হলেন, কপালিয়া ঘোষবাড়ি এলাকার ইকবাল হোসেন, নূর মোহম্মদ গাজী, চিত্তরঞ্জন সরকার, লক্ষ্মী কান্ত (কেরো), রাজেশ্বর নাথ, কপালিয়া সরদারপাড়ার গোলজার হোসেন সরদার, ফজনুর রহমান সরদার, আব্দুস ছামাদ সরদার, মোল্লাপাড়ার আনছার মোল্লা, অজেদ আলী মোল্লা, জোনাব আলী মোল্লা ও কপালিয়া কালিতলা এলাকার মনোরঞ্জন মণ্ডল । এরপর রাজাকাররা ওই এলাকার ফুটকলি, কালিদাস বিশ্বাস ও বনমালী মণ্ডলকেও হত্যা করে।
স্বাধীনতার ৪৫ বছরে শুধু একটি স্মৃতিফলক ছাড়া এই মুক্তিসেনাদের পরিবার-পরিজনের ভাগ্যে কোনও কিছুই জোটেনি। ফলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের স্ত্রী স্বামীর ভিটা ছেড়ে অন্যত্র সংসার পেতেছেন। আবার কেউ কেউ কোলের সন্তানকে নিয়ে স্বামীর ভিটা আঁকড়ে আছেন আজও।
এমন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলজারের স্ত্রী ফরিদা বেগম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি নারী জানান তার জীবন সংগ্রামের করুণ ইতিহাস।
তিনি বলেন, ‘বিয়ের দুই বছর পর স্বামী যুদ্ধে যান। স্বামীকে যখন ওরা মেরে ফেলে তখন কোলে দুই মাসের ছেলে আব্দুল গণি। স্বামীর ভিটায় থেকেই ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এখন পাশের একটি মাদ্রাসায় গণিতের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছে। ছেলের কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে এলাকাবাসীর কাছ থেকে সাহায্য তুলে তাকে ঢাকা ও ভারতে চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি। দুই বছর আগে মারা যায়। ছেলে মারা যাওয়ার পর তার বউমা দুই মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছে। এখন আমি একাই স্বামীর ভিটা আঁকড়ে পড়ে আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছেলের যখন অসুখ হয়, তখন একটা মুক্তিযোদ্ধার সনদের জন্য কত হাঁটাহাঁটি করলাম কিন্তু পাইনি। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের কত রকম সুবিধা দেয়। কিন্তু আমরা কিছুই পাইনি। আমার স্বামী দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তাকে স্বীকৃতি দেয়নি সরকার।’ তাকে এখন ১০ টাকার চালের কার্ড নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
১৫ মুক্তিসেনাকে গুলি করে হত্যার ঘটনা বর্ণনা করেন শহীদ গোলজারের বড়ভাই বজলুর রহমান। তিনিও দেশের জন্য লড়েছিলেন। বলেন, ‘আমরা শতাধিক মানুষ মিলে স্থানীয়ভাবে কপালিয়া, মনোহরপুর, কুমারঘাটা ও চেঁচুড়িয়াসহ আশপাশের এলাকায় যুদ্ধ করি। তখন জেলা বা থানা পর্যায়ের কোনও নেতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। আবার অস্ত্রপাতিও কম ছিল। ওই সময় কাছারিবাড়ি রাজাকার ক্যাম্পের এয়াকুব, নিছার, মেহের ও শরিয়তউল্যাসহ অনেকে আমাদের আত্মসমর্পণের কথা বলে। রাজাকাররা বলেছিল, আমরা যদি তাদের কাছে ধরা দেই তাহলে তারা আমাদের মারবে না। শরিয়তউল্যা আমাদের কোনও ক্ষতি করবে না বলে মসজিদ ছুঁয়ে কসমও করিয়েছিল। আমাদের কাছে অস্ত্রপাতি কম থাকায় যুদ্ধ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই রাজাকারদের হাতে আমাদের ১২ জন আত্মসমর্পণ করে। বাকিরা অবশ্য রাজাকারদের বিশ্বাস করেনি। তাই সবাই সরে ছিলাম।’
বজলুর রহমান বলেন, ‘রাজাকারদের হাতে ধরা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আমার আপন ভাই গোলজার ও চাচাতভাই ফজনু ছিল। রাজাকাররা তাদের ধরে কাছারিবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন আটকে রেখে রাত ১২টার দিকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে কপালিয়া বাজারে এনে গুলি করে হত্যা করে। এর দুই একদিন পর তারা ফুটকলি,কালিদাস ও বনমালীকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মারার তিন দিন পর দেশ স্বাধীন হয়।’
সরকারের কাছে আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দিয়েছেন কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে একবার কোর্ট থেকে তালিকা চেয়েছিল। তখন কোর্টে গিয়ে তালিকা দিয়ে আসি। তাতে কাজ হয়নি বলে পরে আর যোগাযোগ করিনি। তাছাড়া আমাদের এই কপালিয়া এলাকাটি তখন ছিল বদ্ধভূমি। যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল ছিল না। তাই বাড়ির কাজ ফেলে আর যোগাযোগ করা হয়নি।’
২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাবেক হুইপ অধ্যক্ষ আব্দুল ওহাব কপালিয়ার শহীদ স্মৃতি রক্ষায় স্থানীয় বাজারে ‘৭১’ এর বদ্ধভূমি নামে একটি ফলক স্থাপন করেন বলে জানান বজলুর রহমান।
শুধু গোলজারের স্ত্রী ফরিদার নয়, একই পরিণতি ওই সময় শহীদ বাকি ১৪ মুক্তিযোদ্ধার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদেরও। এই ১৫ বীর শহীদ সেনাদের স্বীকৃতি না মেলায় তাদের স্বজনরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসীও। তারা এই বীরসেনাদের স্বীকৃতিসহ সব সুযোগ সুবিধা প্রদানের জোর দাবি জানিয়েছেন।
মনোহরপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কপালিয়ার এই ১৫ শহীদ সেনাকে গুলি করে হত্যার ঘটনা কারও অজানা নয়। এই ত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে শহীদ পরিবারের প্রতি সরকারের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে দেশ ও জাতির জন্য এটা একটি কলঙ্ক হয়ে থাকবে।
মণিরামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার এসএম কওসার আহম্মেদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মণিরামপুরের কপালিয়ায় ১২ জনকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করেছে এমন ঘটনা আমাদের জানা নেই। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’
/এসটি/