X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

শৌচাগারে পরিণত হয়েছে নরসিংদীর গণকবরগুলো

আসাদুজ্জামান রিপন, নরসিংদী
১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৪২আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৪২

পাঁচদোনা বধ্যভূমি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে আছে নরসিংদী জেলাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গণকবরগুলো। চরম অযত্ন-অবহেলায় স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর সেই গণকবরগুলোর চিহ্ন এখন মুছে যেতে বসেছে। অনেক গণকবর মলমূত্র ত্যাগের স্থানে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় মানুষের মধ্যে।

সরেজমিনে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে নরসিংদী জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। জেলাজুড়ে অনেকগুলো বধ্যভূমি থাকলেও সরকারিভাবে এসব চিহ্নিত করা হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সূত্র মতে, নরসিংদী জেলার উল্লেখযোগ্য গণকবরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদী সদর উপজেলার পাচদোনা ব্রিজের পাশের গণকবর, শীলমান্দী মাছিমপুর বিল, খাটেহারা ব্রিজ, শিবপুরে ঘাসিরদিয়া, বেলাব’র আড়িয়াল খাঁ নদীর পাশে বড়িবাড়ী, রায়পুরার মেথিকান্দা রেল স্টেশনের পার্শ্ববর্তী স্থান ও মনোহরদী উপজেলার সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।  এলাকাবাসী  ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে ৩টি গণকবর চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো বেলাব’র বড়িবাড়ী, রায়পুরার মেথিকান্দা ও নরসিংদী সদরের পাচদোনা । এগুলোও অরক্ষিত ও অযত্নে পড়ে আছে।

মনোহরদীর গণকবরে টয়লেট

মনোহরদী উপজেলা সদরে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। তারা নিরীহ বাঙালিদের এখানে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করত। পরে তাদের লাশ ব্র‏হ্ম‏পুত্র নদীর তীরে গণকবর দেওয়া হতো। এছাড়া বর্তমান সাবরেজিস্ট্রি অফিস সংলগ্ন নদীর তীরে অনেক লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও সরকারিভাবে স্থানটি চিহ্নিত না করায় সে স্থানে গড়ে উঠে মার্কেট, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার ও মডেল স্কুলের পৃথক পৃথক টয়লেট ও টয়লেটের ট্যাংকি। তাই বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই সব গণকবরের ইতিহাস জানে না।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান মানিক ও মোহাম্মদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই গণকবরগুলোর বেহাল দশা দেখে আমরা খুব দুঃখিত ও ব্যথিত। কারণ মুক্তিযুদ্ধের এই গণকবরে স্মৃতিসৌধের পরিবর্তে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের টয়লেট দেখতে হচ্ছে এবং মানুষ অবাধে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করছে। এর চেয়ে অবহেলা আর কী হতে পারে? আমরা আশা করছি সরকার এ স্থানটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবেন।’

মনোহরদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘গণকবরগুলো চিহ্নিত করার জন্য আমরা বারবার প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষায় এখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হোক যাতে আমরা শ্রদ্ধা জানাতে পারি।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। গণকবর অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে শুনেছি যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ বিষয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ মনোহরদীর গণকবর

বেলাব’র গণকবর

বছর ঘুরে ১৪ জুলাই দিনটি ফিরে এলেই বেলাব’র বড়িবাড়ী এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। সেদিন ৫ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ বেলাব ও তার পাশ্ববর্তী এলাকার ৬৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী। তাদের হাত-পা ও চোখ বেঁধে হত্যা করে লাশগুলো ফেলে দেওয়া হয় আড়িয়াল খাঁ নদীতে। আবার অনেক লাশ একসঙ্গে আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে বড়িবাড়ীতে মাটিচাপা দেওয়া হয়। বড়িবাড়ীর এ স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও অযত্ন অবহেলায় এটি বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। ভেঙে গেছে অনেকাংশ।  গরু, ছাগল, কুকুরসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবাধ বিচরণস্থলেও পরিণত হয়েছে স্থানটি। এলাকাবাসীর উদ্যোগে এখানকার যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সুবেদার বাশারের লাশটি সমাহিত করা হলেও তা ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে অযত্নে পড়ে আছে। এস্থানটি সরকারিভাবে সংরক্ষণের দাবি জানানো হলেও কোনও ফল হয়নি।

মেথিকান্দা গণকবর

১৯৭১ সালে রায়পুরার মেথিকান্দা রেল স্টেশনের কাছে রেল লাইনের পাশে বর্তমান উপজেলা পরিষদের টর্চার সেলে ৫ মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৩০ জন নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করার পর পাকিস্তানি বাহিনী এ স্থানে মাটি চাপা দেয়। প্রতি বছর এখানে নিহতদের স্মরণে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে শ্রদ্ধা জানান। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পার হলেও আজো গড়ে উঠেনি কোনও স্মৃতিস্তম্ভ। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম নূরুজ্জামান, বীর বিক্রম খন্দকার মতিউর, বীর বিক্রম শাহাবুদ্দিন ও বীর প্রতিক মোবারক হোসেনসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার জন্মভূমি রায়পুরা। মেথিকান্দার এ গণকবরটি উপজেলার একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন হলেও এখানও অবহেলিত।

পাঁচদোনা লোহাপুল গণকবর

নরসিংদী সদর উপজেলার একমাত্র বধ্যভূমি পাচদোনার লোহারপুল। জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ২৮ জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প নরসিংদীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটকে রেখে নির্যাতন শেষে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হতো বর্তমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা মোড় সংলগ্ন লোহাপুলের নিচে। সেখানে হানাদাররা তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে লোহারপুলের নিচে সবাইকে একসঙ্গে মাটি চাপা দেওয়া হয়। এ স্থানটিকে স্মরণীয় রাখতে আজও সরকারি-বেসরকারি কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। একটি স্মৃতি ফলক থাকলেও তা ভেঙে পড়ে আছে।

নরসিংদী সদর উপজেলায় নেভাল সিরাজের নেতৃত্বে হানাদার প্রতিরোধ দূর্গ গড়ে তোলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় নরসিংদী জেলা ছিল ২নং সেক্টরের অধীনে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ। নরসিংদীকে ৩ নং সেক্টরের অধীনে নেওয়া হলে কামান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. নূরুজ্জামান।

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে নরসিংদী পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়েছিল।  মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি নরসিংদীবাসীর কাছে অত্যন্ত গৌরবোজ্জল ও স্মরণীয় দিন। ৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ডযুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর হামলায় শহীদ হন ১১৬ জন বীর সন্তান। এর মধ্যে নরসিংদী সদরের ২৭,মনোহরদীর ১২,পলাশে ১১,শিবপুরের ১৩, রায়পুরায় ৩৭ ও বেলাব উপজেলার ১৬ জন।

নরসিংদী জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সমুন্নত রাখতে স্বাধীনতার ৩৪ বছর পর ২০০৫ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। তবে শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো শহীদদের নামে নামকরণ করার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। নরসিংদীবাসী অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিফলক নির্মাণ ও নামকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান।

আরও পড়ুন- 


নিখোঁজ ৭ জনকে নিয়ে সংশয় পুলিশের, মেলেনি খোঁজ

/আরএইচ/এফএস/ 

সম্পর্কিত
নানা আয়োজনে রাজধানীবাসীর বিজয় উদযাপন
বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা
জাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
সর্বশেষ খবর
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী