X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

দেড় বছর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নিয়েছেন এক ‘রাজাকার’!

তৌহিদ জামান, যশোর
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:৩০আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৯:৪৮

রইস উদ্দিনের সাময়িক সনদ স্বাধীনতার আগে ছিলেন মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ কর্মী। অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে  হাত মিলিয়েছিলেন।  স্বাধীনতার পর থেকে তিনি এলাকায় পরিচিত রাজাকার হিসেবে।  তবে এসব ছাপিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের খাতায় নাম রয়েছে তার। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি প্রায় দেড় বছর ধরে ভাতাও তুলেছেন। তিনি যশোরের মনিরামপুরের রইস উদ্দিন আহমেদ (৬৫)। যার নাম মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে ১০৫৪২ নম্বরে রয়েছে।

জানা গেছে, যশোরের মণিরামপুরে ২৮৬ জন ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে রইস উদ্দিন আহমেদও রয়েছেন। তবে সম্প্রতি জেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি তাকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট দফতরে সুপারিশও পাঠিয়েছে কমিটি। যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যসচিব (ইউএনও) মোহাম্মদ অতুল মণ্ডল বলেন, ‘বাছাই কমিটিতে রইসের নাম ডাকা হলে উপস্থিত সবাই একবাক্যে বলে ওঠেন, রইস একজন রাজাকার। তাছাড়া সে শুনানিতে অংশও নেয়নি। কমিটির সিদ্ধান্ত মতে, তাকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’ তিনি আরও জানান, এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে রইসের সব স্বীকৃতি বাতিল করে ইতোমধ্যে তাকে দেওয়া সব সুবিধা ফেরতের সুপারিশ করেছে কমিটি।

তবে এখন কেন রাজাকার অভিহিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে রইস উদ্দিন বলেন,  ‘আমিও নিজেও জানি না।’ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করার চিঠি

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, মণিরামপুর উপজেলার রোহিতা ইউনিয়নের পলাশী গ্রামের মৃত হাবিবুল্লার ছেলে রইস উদ্দিন। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিবাহিনীর বহু অস্ত্র রাজাকারদের হাতে তুলে দেওয়ায় রইসের আপন দুই ভাই ইউনুস ও আব্দুল মান্নান এবং তাদের মামাতো ভাই দেলোয়ারের প্রাণ যায় মুক্তিবাহিনীর হাতে। কিন্তু ওই সময় মুক্তিযোদ্ধারা রইসের বাড়ি ঘেরাও করলেও ঘরের বেড়া ভেঙে হরিহর নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান রইস। এরপর এলাকা ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি নোয়াখালীতে চলে যান তিনি। সেখান থেকে তিনি সেনাবাহিনীতে কাজ শুরু করেন। চাকরি শেষে আবার তিনি যশোরের নিজ এলাকায় ফিরে আসেন।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালে গেজেটভুক্ত হয়ে ২০০৫ সালের দিকে রইস উদ্দিন একটি সাময়িক সনদপত্র পান। এরপর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেড় বছর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উঠিয়েছেন। প্রভিশনাল সার্টিফিকেট

রাজবাড়ীয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের ছেলে আব্দুল কাদের বলেন,‘আমার বাবার নামের বানানে সমস্যা ছিল। চলতি মাসের ১২ তারিখে আমরা উপজেলায় যাই। রইস উদ্দিন সেখানে আমাদের দেখে বলেন, ‘তোরা তো আসল মুক্তিযোদ্ধা। তাহলে এখন আবার কাগজপত্র নিয়ে দৌঁড়াদৌড়ি কেন? এসব তো আমরা করবো’।  আবদুল কাদের আরও বলেন, ‘এলাকায় রইস গর্বের সঙ্গে রাজাকার বলে নিজের পরিচয় দেন।’

রোহিতা ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লেয়াকত আলী বলেন,‘রইস শুধু রাজাকারই না, সে এতটাই খারাপ ছিল যে তার মতের বাইরে কেউ গেলে তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করতো সে। এখনও এলাকার মানুষ তাকে ভয় পায়।’ তিনি আরও বলেন,‘রইচের শ্বশুর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার হাত ধরে রইস মুক্তিযোদ্ধার কার্ড করিয়েছে।’

রোহিতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাফিজুর রহমান হাফিজ বলেন, ‘রইস চিহ্নিত রাজাকার। টাকার বিনিময়ে সে মুক্তিযোদ্ধার কার্ড করিয়েছে। সে যদি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ভাতা পায়, তাহলে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কলঙ্কিত করা হবে।’

এসব বিষয়ে কথা হয় অভিযুক্ত রইস উদ্দিনের সঙ্গে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেছে তারা আমার কাছে তাদের গরু-ছাগল রেখে যায়। আমি সেগুলো বেচে তাদের কাছে টাকা পাঠাতাম।’ তিনি আরও বলেন,‘যুদ্ধের সময় স্থানীয় একটি কোন্দলকে কেন্দ্র করে এক রাতে ৪ থেকে ৫ জন মুখোশধারী লোক আমার বাড়ি আক্রমণ করলে ঘরের বেড়া ভেঙে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আমি পালিয়ে যাই। তারপর নোয়াখালীতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে ভারতের আসামে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সেখানকার কাগজপত্র জমা দিয়ে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাই।’

তিনি আরও জানান, ১৯৭১ সালের জুলাইয়ের শেষের দিকে তিনি নোয়াখালী যান। তিনি ১ আগস্ট মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর ওই মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতে যান।

তিনি জানান, ওই সময়ে খালেদ মোশাররফের সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন এটিএম হায়দায়। পরে সেপ্টেম্বরে ভারত থেকে নোয়াখালীতে এসে ওয়ালি উল্লাহর নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন।  এরপর সেপ্টেম্বরে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকা যাচাই বাছাইয়ের শুনানিতে যাননি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ ছিলাম। যখন সুস্থ হলাম, তখন যাওয়ার পর জানতে পারি আমাকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে কমিটি। এর কারণ আমি নিজেও জানি না।’

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে ওই এলাকার মুক্তিবাহিনীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আকরাম আলী ও তার সহযোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে চলতি মাসের ১২ তারিখে যাচাই-বাছাই কমিটির শুনানিতে অংশ নিতে উপজেলায় যান রইস উদ্দিন। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে পড়ে সেখান থেকে পালিয়ে রক্ষা পান তিনি।

মণিরামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এমএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রইসকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত এবং তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট দফতরে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।’ 

/এমডিপি/এফএস/ 

আরও পড়ুন- 


এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তল ডা. কাদেরের বাড়ি থেকে উদ্ধার

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
সর্বাধিক পঠিত
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা