X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুর আগে সব রাজাকারের বিচার দেখে যেতে চান স্বজনহারা নূর বানু

আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ
০৩ মার্চ ২০১৭, ০৯:৪৭আপডেট : ০৩ মার্চ ২০১৭, ০৯:৪৭

নূর বানু বেওয়া একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সাক্ষী সত্তরোর্ধ নূর বানু বেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদরদের নিষ্ঠুরতার কথা স্মরণ করে এখনও তিনি ডুকরে কেঁদে উঠেন। মনের অজান্তে গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছেন শাড়ির আঁচলে। একাত্তরে স্বামীসহ অন্য আরও স্বজনহারা নূর বানু বেওয়ার আশা, একদিন পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তাকারী সেই যুদ্ধাপরাধী রাজাকার ও আলবদরদের বিচার হবেই। মৃত্যুর আগেই সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখে যেতে চান তিনি।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তাগাছার গোটা বিনোদবাড়ি মানকোন গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি নারী, শিশু ও সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরাও। হত্যার পর অগ্নিসংযোগ করে গ্রামের বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় হানাদাররা।

নূর বানু বলেন, সেদিন ছিল ১৫ শ্রাবণ, ২ আগস্ট, সোমবার-১৯৭১ সাল। মুক্তাগাছা জামালপুর সড়কের চেচুয়ার পথে ‘দড়িকৃষ্ণপুর’ এই মানকোন গ্রামেরই একটি পাড়া। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১১টার ঘরে। মারাত্মক সর্দি জ্বরে আক্রান্ত তিন মাসের শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন গৃহবধূ নূর বানু। এরই মধ্যে খবর আসে পাকিস্তানি আর্মি আসছে। অনেকের মত নূর বানু স্বামীর সঙ্গে সন্তানদের নিয়ে ঘরের ভেতর আশ্রয় নেন। স্থানীয় রাজাকার জবেদ মুন্সি দুই সেনাসদস্যকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে নূর বানুর স্বামী রহমত আলী ও দেবর মোতালেবকে ডেকে বাড়ির উঠানে নিয়ে আসে। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি করে লাশ ফেলে দেয় উঠানে। ভয়ে জড়সড় নূর বানুর ভাশুর কোরান শরীফ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকেও গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা। এসময় বাড়ির মহিলাদের চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে বাইরে এনে বুকে, পেটে ও পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে লাশ ফেলে রাখে উঠানে। হানাদারদের গুলিতে সেদিন এই বাড়ির ১৮ জন শহীদ হন। এখানে নির্বিচারে গ্রামবাসীকে হত্যা করে হানাদাররা

বিনোদবাড়ি গ্রামের আতিকুর রহমান (৫৫) ও মনসুর আলী (৬০) জানান, ‘রাজাকার হাক্কু ও আমজাত বলবাড়িতে মহিলা ও শিশুদের আশ্রয় নিয়েছে বলে পাকিস্তানি সেনাদের সেখানকার পথ দেখিয়ে দেয়। হানাদাররা বাড়ির ভেতর থেকে মহিলা ও শিশুদের বাইরে এনে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। হানাদারদের গুলিতে সেদিন এই বলবাড়িতে তিন শিশুসহ ১৭ মহিলা শহীদ হন।’

সেদিন রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের নল থেকে বেঁচে যাওয়া মনুসর জানান, ‘বলবাড়িতে এই হত্যাকাণ্ডের পর মহিলা ও শিশুদের নাড়িভুঁড়ি ছিটকে গাছের ডালে ও ঘরের বেড়ায় ঝুলে ছিল। গোসল ও কাফন ছাড়াই পরনের রক্তাক্ত কাপড়ে ১৭ জনকে সেদিন এক কবরে পুতে রাখা হয়।’

একই গ্রামেরই হাফিজা খাতুন (৬০) জানান, ‘পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে অনেকের সঙ্গে আমার স্বামী কুমেদ আলী আশ্রয় নিয়েছিল স্থানীয় বাইয়া বিলে। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে গিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। খবর পেয়ে পরদিন বাইয়া বিলের শত লাশের স্তুপ থেকে শহীদ স্বামীর লাশ নিয়ে বাড়িতে আসি। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছরেও এই শহীদ পরিবারের কেউ খোঁজ নেয়নি।’

কাতলসার শহীদ স্মৃতি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর আলী (৫৫) জানান, ‘রাজাকার করিম মুন্সির সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদাররা সেদিন ২৮ জনকে ধরে নিয়ে স্থানীয় কৈয়ার বিলপাড়ে জড়ো করে বসিয়ে রাখে। পরে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। যাদের গুলি লাগেনি তারা মরার ভান করে পড়ে থেকে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান। তবে শহীদ হন ১৪ জন।’

এই গ্রামের শহীদ পরিবারের সদস্য কায়া রাণী দে (৭৩) জানান, ‘রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা ঠাকুর বাড়ির যতীন্দ্র কুমার রায়, দিলীপ কুমার ঠাকুর, নারায়ন কুমার দে ও জীতেন্দ্র প্রসাদ ঠাকুরকে গুলি করে হত্যা করে।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য তাজ উদ্দিন (৬৩) জানান, ‘ময়মনসিংহ থেকে সরাসরি পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় রাজাকার নঈম উদ্দিন মাস্টার, জবেদ আলী মুন্সি, করিম ফকির, আতিকুর রহমান, আব্দুস সালাম, নজর আলী ফকিরের সহাতায় বিনোদবাড়ি মানকোন গ্রামে প্রবেশ করে। পরে তারা নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।’ মানকোন গ্রামের সেই বধ্যভূমি

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমের (৬৫) দাবি, ‘একদিনে সকাল বিকালের এই নিষ্ঠুর বর্বরতায় শিশু ও মহিলাসহ ২৫৩ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক এমপি মৃত কেরামত আলী তালুকদারের পরামর্শে মুক্তাগাছা থানা সদরের রাজাকার ও আলবদর কমান্ডার দু’সহোদর চান-সুরুজ এসব হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করে।’

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তাগাছার সাবেক এমপি খোন্দকার আব্দুল মালেক শহীদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিনোদবাড়ি মানকোনসহ মুক্তাগাছায় প্রায় সহস্রাধিক মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং দুই থেকে আড়াইশ’ গণকবর ও বধ্যভূমি আছে এ এলাকায়। এসব গণকবর এবং বধ্যভূমি চিহিৃত করা হলেও সংরক্ষণ করা হয়নি।’

/এসএনএইচ/এফএস/ 

আরও পড়ুন- 

‘এ ধর্মঘট আমারে কী দিলো?’
বাস মালিকরাও যে কারণে শ্রমিকদের ধর্মঘটে নামিয়েছিলেন

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯ মাসে ৪৩৫৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯ মাসে ৪৩৫৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা