X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘মাইনা’ থেকে জঙ্গি মুসা

দুলাল আব্দুল্লাহ, রাজশাহী
৩০ মার্চ ২০১৭, ১৩:৩৬আপডেট : ৩০ মার্চ ২০১৭, ১৪:৪৩

জঙ্গি মুসা রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বুজরুক কোলা গ্রামের আধা-পাকা একটি বাড়িতে বেড়ে ওঠে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিনের (নব্য জেএমবি) অন্যতম শীর্ষ নেতা মঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা। গ্রামের সবার কাছে সে ‘মাইনা’ নামে পরিচিত ছিল। তবে সেখান থেকে মাইনা কীভাবে ‘জঙ্গি মুসা’ হয়ে উঠল, বাংলা ট্রিবিউনকে তা জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
বাগমারা উপজেলার বুজরুক কোলা গ্রামে আবুল কালাম আজাদ ছিলেন শিক্ষিত ব্যক্তি। উত্তরাধিকার সূত্রে ৮০ বিঘা জমি পাওয়ায় বিএ পাস করেও তিনি কোন চাকরিও করেননি। তবে দুই স্ত্রীর পাঁচ সন্তানকে লেখাপড়া করাতে গিয়ে বিভিন্ন সময় জমি বিক্রি করেন।তার বড় ছেলে খায়রুল ইসলাম মেধাবী না হওয়ায় এলাকায় কিটনাশকের দোকান করে দেন। আর মঈনুল ইসলাম ওরফে ‘মাইনা’ ওরফে মুসা মেধাবী হওয়ায় তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন আবুল কালাম আজাদ।
এলাকার কৃষক মহসিন বলেন, ‘মাইনার বাবা স্বপ্ন দেখতেন এই ছেলেই তার মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু সে এমন কাজ করলো যে, সারাবিশ্বে এই গ্রামের নামে বদনাম হয়ে গেল। তার বাবা বেঁচে থাকলে এই খবর শুনে হ্যার্ট অ্যাটাক করতেন।  এখন আবুল কালামের  স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের কী কষ্টই না হচ্ছে। ইসলাম তো মানুষকে হত্যা করতে বলে না। তাহলে কেন এই কাজে সে জড়িয়ে পড়ল?’
এলাকার দোকানদার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ এলাকার ছেলে হিসেবে আমরা সবাই তাকে ভালোবাসতাম। আমার দোকানে এসে মাঝেমধ্যে সে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেতো। আবার নামাজ-রোজাও নিয়মিত করতো। অন্যের জমিতে কৃষিকাজও করতো। কিন্তু ঢাকায় যাওয়ার পর তার আচরণ বদলে গেল। এলাকায় আসলে আমার দোকানে সে আর আসতো না।’
প্রতিবেশী আতাউর রহমান জানান, ‘ঢাকা থেকে গ্রামে আসার পর মাইনা তার ল্যাপটপে আমাকে ইসলামি ওয়াজের ভিডিও দেখিয়ে বলেছিল, এলাকায় আর গান-বাজনা হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘‘ওই সময় সে আমার কাছে পান বরজসহ পাঁচ কাঠা জায়গা বিক্রি করতে চেয়েছিল। সে বলেছিল, ‘বিদেশে যেতে আমার অনেক টাকা লাগবে। তাই জমি বিক্রি করবো। সঙ্গে স্ত্রী, ছেলে ও মাকেও নিয়ে যাবো।’ কিন্তু তার মা যেতে চাননি। পরে বোন জামাই মহসিনের কাছে জমি বিক্রি করে মাইনা।’’

মচমইল হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র জাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘ভাইয়াকে (মাইনা ওরফে মুসা) কলেজে শিক্ষকতার জন্য চাকরির অফার করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি ইংরেজি ও অঙ্ক খুব ভালো পারতেন। তাই তার কাছে অনেকে প্রাইভেট পড়তে চাইতো। কিন্তু ঢাকা থেকে আসার পর তিনি কাউকে প্রাইভেট পড়াতেন না।’

মচমইল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী সাগর আলী বলেন, ‘আমি তার কাছে ক্লাস সেভেনে প্রাইভেট পড়েছি। এখন তার বিষয়ে ভাবতে কেমন লাগছে।’

এলাকার মাসুম আলী বলেন, ‘তার বাবা মারা যাওয়ার পরের দিন আমার সঙ্গে তার কথা হয়। ওই সময় সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এখন কী করছি? আমি বলেছিলাম, বিদেশে যাবো। তখন সে বলেছিল, বিদেশ যাওয়া ভালো না। দেশে কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু সে যে দেশের জন্য এই কাজ করবে, আমরা কেউ তা ভাবিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘‘মাইনার পড়ালেখার জন্য তার মা কাঁথা সেলাই, কলা চাষ, এমনকি অসুস্থ ব্যক্তিদের হাসপাতালে নেওয়ার কাজ করতেন। তার মাকে বলতে শুনেছি, মেজর জাহিদের পাল্লায় পড়ে তার  ছেলেটা গোল্লায় গেছে। কারণ মেজর জাহিদের মেয়েকে সে বাড়িতে গিয়ে পড়াতো। একারণে তার সঙ্গে নামাজপড়া থেকে শুরু করে সব বিষয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। আর তার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে জঙ্গি কাজে জড়িয়ে পড়ে মুসা।’

মাসুম আলী বলেন, ‘সে বাংলা ভাইয়ের আমলের জঙ্গি ছিল না। কারণ তার আচরণ আমরা জানি। তখন সে খুব ছোট ছিল। আবার এই বিষয়ে তার তেমন মাথাব্যাথাও ছিল না।’

মাসুম আলী আরও বলেন, ‘২০০২ সালে মচমইল হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৫ সালে তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং এক বছর বিরতি দিয়ে রাজশাহী কলেজে ইংরেজি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু টান্সফার হয়ে ঢাকা কলেজে সে ভর্তি হয়ে ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে। এই পর্যন্ত ঢাকায় গিয়ে সে ভালো ছিল বলে মনে হয়েছে আমাদের। কিন্তু ঢাকার উত্তরায় লাইফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতার সময় থেকে হয়তো মেজর জাহিদের সঙ্গে তার আবারও যোগাযোগ হয়। তখনই সে জঙ্গিদের কাজে জড়িয়ে পড়ে। সে আসলে আমাদেরকে এই ব্যাপারে কিছু বলতো না। আবার এলাকায় সে আসলে অপরিচিত কোনও ব্যক্তির আনাগোনাও দেখতাম না। সে ছিল খুবই মেধাবী। বাংলা, ইংরেজি এবং আরবি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতো মাইনা (মুসা)।’

তিনি আরও বলেন, ‘একবার  সে তার বাবার ৪০ হাজার টাকা চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে তার বাবা তাকে গ্রহণ করছিল না। অনেকে বুঝিয়ে তাকে আবার ঘরে তুলেছিল এলাকাবাসী। তখন পড়ালেখায় আরও ভালো করলো মুসা।’

এলাকাবাসী জানায়,বাগমারা উপজেলার সাঁইপাড়া গ্রামের ও বাসুপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদের মেয়ে তৃষ্ণাকে কাজী ছাড়া নিজেই কলমা পড়ে বিয়ে করেছিল মুসা। এনিয়ে এলাকায় একটু গণ্ডগোল হয়েছিল। বাড়িতে আনার পর তার বৌকে কেউ দেখতে পারেনি।

এলাকাবাসী আরও জানায়, মুসার মা তার বাবার প্রথম স্ত্রী ছিলেন। তালাকের পর তিনি বাপের বাড়ি চলে যান। মুসার রবাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন খদিজা বেগম। ওই ঘরে একটি ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। খাদিজার মেয়েরা চাকরি করেন। পরে মুসার মা আবারও ফিরে আসলে দুই স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন মুসার বাবা। মুসার বাবা পেশায় মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন।

/এসএনএইচ/ এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ