বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাওরের পানি বেড়ে নতুন করে এক হাজারেরও বেশি হেক্টর জমি ধানসহ ডুবে গেছে। এদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে ভারত থেকে আসা ঢলে প্রায় দুই হাজার বিঘা জমির কাঁচাপাকা ধান নষ্ট হয়ে গেছে।
আমাদের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে নতুন করে মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওরে আরও ১৪০৩ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। ফের বৃষ্টি হলে যে জমিটুকু এখনও উঁচুতে আছে, তার ধানও তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুব্রত কান্তি দত্ত।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রাজনগর উপজেলায় কাউয়াদীঘি হাওরে নতুন করে ৬২৩ হেক্টর জমির এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওরে নতুন করে ৬২০ হেক্টর জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এই ফসলের অধিকাংশই গত মাসে হওয়া আকস্মিক বন্যার সময় তলিয়ে গিয়েছিল। পরে পানি কমলে তা আবার ভেসে উঠে। কৃষি বিভাগ ভেসে উঠা ধানকে আংশিক ক্ষতি হিসেবে ধরেছিল।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নীলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘সোমবার দিনব্যাপী সরেজমিনে হাওর পরিদর্শন করেছি। হাওর এলাকা ভুনবীর, মির্জাপুর, শ্রীমঙ্গল ও কালাপুর ইউনিয়নে ধান পানিতে ডুবে গেছে।’ রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মিহির কান্তি দাস বলেন, ‘বৃষ্টিতে হাওরে পানি অন্তত দুই হাত বেড়েছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আনিসুর রহমান বলেন, ‘পানি কমে গিয়েছিল। আবার একাধারে বৃষ্টি ও উজান থেকে বিভিন্ন ছড়া দিয়ে পানি ঢোকায় হাওরের পানি বেড়ে গেছে। অপরদিকে কুশিয়ারার পানি হাওর থেকে অন্তত ছয় ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।’
হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর লাখাই অংশের বাঁধ ভেঙে নতুন করে আরও ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ফলে শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। পানি বাড়তে থাকায় কৃষকরা জমির আধাপাকা ধান কাটতে শুরু করেছেন। লাখাই উপজেলার ভরপূর্ণি বুল্লা হাওরসহ আশাপাশের ১৬ হাজার কৃষক এরমধ্যেই নিঃস্ব হয়েছেন। এ নিয়ে জেলায় মোট ৫৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এর পরিমাণ আরও বাড়বে।জেলায় চলতি বছরে একলাখ ১৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছিল। এদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে অতিরিক্ত বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় এক হাজার ৮৪০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার কৃষক। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে মঙ্গলবার পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা কোনও ধরনের সরকারি সাহায্য পাননি।
স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে জেলার নাসিরনগর উপজেলায়। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে সেখানকার প্রায় ১১৫০ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। এরপরই বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার বিজয়নগর উপজেলায়। ওইসব এলাকার কৃষকরা পানিতে ডুবে থাকা জমির পাকা ধান তুলতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ভারত থেকে নেমে আসা পানির ঢলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে প্রায় দুই হাজার বিঘা জমির পাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল হারিয়ে এখন দিশেহারা শত শত কৃষক। পানির ঢল অব্যাহত থাকলে আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে আরও ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ।
গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মাসুদ হোসেন জানান, ‘নওগাঁর সাপাহার উপজেলার ওই পারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের পুনর্ভবা নদীর ওপর একটি স্লুইস গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে পার্শ্ববর্তী গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করায় এই ক্ষতির মুখে পড়েছে স্থানীয় কৃষকরা। যতই সময় গড়াচ্ছে ততই নতুন নতুন এলাকার ধানের ক্ষেত তলিয়ে যাচ্ছে।’
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার সাদুল্যাপুর-মিরপুর পাকা সড়কের মিরপুর বাজার এলাকায় গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে শত শত বিঘা জমির আধাপাকা ইরি-বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সাদুল্যাপুর-মিরপুর পাকা সড়কের মিরপুর বাজারের পূর্বে সড়কের ওপর শত বছরের একটি পুরাতন কালভার্ট রয়েছে। কালভার্টটি রসুলপুর, জামালপুর ও ফরিদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন নিচু ও নালা দিয়ে প্রবাহিত পানি নিষ্কাশনের মূল পথ। কিন্তু কালভার্ট ঘেঁষে দক্ষিণ পাশে মাটি ভরাট করে একটি মিল-কারখানা নির্মাণ করছেন জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান মণ্ডল। বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথটি বন্ধ হওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ করে জলাবদ্ধতার কারণে কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কালভার্টের উত্তরপাশের মিরপুর, তাজপুরসহ অন্তত পাঁচ গ্রামের শত শত বিঘা জমির আধাপাকা ইরি-বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
/এফএস/ এপিএইচ/
আরও পড়ুন-
খোয়াই নদীর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে আরও ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল