X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

আরও একটি বাড়ি বানাচ্ছিল জঙ্গি আব্দুল্লাহ!

নয়ন খন্দকার, ঝিনাইদহ
২৬ এপ্রিল ২০১৭, ১১:২৬আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৫৭

জঙ্গি আবদুল্লাহ আরেকটি বাড়ি

ঝিনাইদহে যে ধর্মান্তরিত মুসলমান আব্দুল্লাহ’র বাড়িকে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে শনাক্ত করেছে পুলিশ তার আরও একটি বাড়ির সন্ধান মিলেছে। জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কংশী গ্রামে ১০ শতক জমির ওপর নতুন বাড়িটি বানানোর কাজ শুরু করেছিল সে। একজন শ্যালো ইঞ্জিনচালকের এত অর্থের উৎস নিয়ে গ্রামবাসী প্রশ্ন তুলে মনে করছেন, জঙ্গি হওয়ার কারণে বাইরে থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েই এমন সম্পদশালী হয়েছিল আব্দুল্লাহ। আর  তার আগের বাড়িটির মতো এই বাড়িটিও হয়তো ব্যবহার করা হতো জঙ্গি আস্তানা হিসেবে। 

প্রভাত কুমার, ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আবদুল্লাহ

জানা গেছে, কংশী পূর্ব পাড়ার ফারুক হোসেনের কাছ থেকে দেড় মাস আগে সে ১০ শতক জমি ক্রয় করে। আলমসাধু (শ্যালো ইঞ্জিনচালিত যান) চালিয়ে সাধারণভাবে জীবনযাপনকারী আব্দুল্লাহ একের পর এক জমি কিনে বাড়ি করার ঘটনায় তার আয়ের উৎস নিয়ে এলাকাবাসী মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এত টাকা সে কোথা থেকে পাচ্ছে তা নিয়ে ওই এলাকাবাসীর মধ্যে চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা।

কংশী পূর্বপাড়ার ফারুক হোসেন জানান, তিনি শহরের একটি পেট্রোল পাম্পে কাজ করেন। গত দেড় মাস আগে আব্দুল্লাহ ১০ হাজার টাকা শতক দরে তার কাছ থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে ১০ শতক জমি কেনে। এর কিছুদিন পর আব্দুল্লাহ তার নামে জমিটি রেজিস্ট্রি করে নেয়।

আরও একটি বাড়ি বানাচ্ছিল জঙ্গি আব্দুল্লাহ!

কংশী গ্রামের কাশেম মণ্ডল জানান, প্রায় ১৫ দিন আগে হঠাৎ করে তার বাড়ির সামনে ইট, বালি, বাঁশ ফেলতে থাকেন এক ব্যক্তি। পরে দেখেন, তার বাড়ির সামনের জমিতে অপরিচিত এক ব্যক্তি পাকা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। যারা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন তারাও এলাকার পরিচিত রাজমিস্ত্রি ছিল না। ওই মিস্ত্রিদের এলাকার কেউ চিনেও না। মিস্ত্রিদের মধ্যে একজনের বাড়ি কুষ্টিয়ায় ও অপরজনের বাড়ি ঝিনাইদহ বাইপাসে বলে পরিচয় দিত। তবে কুষ্টিয়ায় কোথায় বাড়ি তা সে বলতো না।

অপরদিকে যে তার বাড়ি বাইপাসে বলে পরিচয় দিতো, সেই উল্টো এলাকাবাসীর কাছে  জানতে চাইতো ঝিনাইদহ বাইপাসে কিভাবে যাবে? ওই দুই মিস্ত্রির এসব কথা শুনে তাদের ব্যাপারে সন্দেহ বাড়তে থাকে এলাকাবাসীর।

এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ কাশেম মণ্ডল আরও জানান, মানুষ গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে বাড়ি করে আর শহরের লোক গ্রামে এসে বাড়ি করছে দেখে তিনি অবাক হন। তিনি আরও জানান, যে মিস্ত্রিরা বাড়ি নির্মাণের কাজ করছিল তারা সেখানে টিনের ছাপড়া (ঘর) করে থাকতো। কখনও  তারা বাইরে বের হত না। রাস্তায়ও আসতো না। এমনকি পাশের চায়ের দোকানেও চা খেতে যেত না। এটা দেখে তাদের সন্দেহ হয় যে এরা কেমন মানুষ। সকালে ও সন্ধ্যায় ওই বাড়ির মালিক (আব্দুল্লাহ) মোটরসাইকেলে চড়ে এসে মিস্ত্রিদের ভাত দিয়ে যেত।

আরও একটি বাড়ি বানাচ্ছিল জঙ্গি আব্দুল্লাহ!

একই গ্রামের আব্দুর রহমান বলেন, আমি ওই মিস্ত্রিদের সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করতাম। সেখানে ৪টি রুম ও দুই বাথরুম বিশিষ্ট বাড়িটি নির্মাণ করা হচ্ছিল। মিস্ত্রিরা কারো সঙ্গে তেমন কথা বলতো না। কোথাও যেতো না। রাতে ওই টিনের ছাপড়ার মধ্যে থাকতো। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, শুক্রবার বিকেলে পোড়াহাটির ঠনঠনে পাড়ার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আগ মুহূর্তে ওইদিন দুপুরেই দুই মিস্ত্রি কাজ ফেলে  দ্রুত গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এর কয়েক ঘণ্টা পর তিনি জানতে পারেন পোড়াহাটিতে আব্দুল্লাহ বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। তিনি ধারণা করেন, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে এই দুই মিস্ত্রিও জড়িত। তা না হলে তারা দ্রুত পালিয়ে যাবে কেন?

অপরদিকে আব্দুল্লাহর মা সন্ধ্যা রানী জানান, তার তিন ছেলে। এদের মধ্যে প্রভাত ( ধর্মান্তরিত আব্দুল্লাহ) হচ্ছে সবার ছোট। প্রায় ১৫ বছর আগে সে পোড়াহাটির শরিফুলের তেল পাম্পে কাজ করতো। সে সময় তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সৃষ্টি হয় পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল লতিফের সঙ্গে। ৯ বছর আগে জানতে পারেন তার ছেলে মুসলমান হয়েছে। কিন্তু, জিজ্ঞাসা করলে বাড়িতে সে তা প্রকাশ করতো না। তার কয়েক বছর পর জানতে পারেন ছেলে প্রভাত (আব্দুল্লাহ) ওই বন্ধুর মেয়ে ফাতেমা ওরফে রুবিনাকে বিয়ে করেছে। যদিও এর আগেই দুইবার বিয়েও করেছিল সে। প্রথম ঘরে একটি মেয়ে ও দ্বিতীয় ঘরে দুটি ছেলে রয়েছে তার।

আরও একটি বাড়ি বানাচ্ছিল জঙ্গি আব্দুল্লাহ!

এদিকে, ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আব্দুল্লাহর আচার আচরণে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন তারা। কথায় কথায় রাগসহ সবাইকে মারধর করতে উদ্যত হতো সে।

সন্ধ্যা রানী আরও জানান, একদিন এসে সে (প্রভাত ওরফে আব্দুল্লাহ) ধানহাড়িয়া গ্রামের বাড়ি থেকে  জোর করে ৪ টি গরু, ৩ টি ছাগল নিয়ে যায়। এছাড়া ঘর-বাড়ি, জায়গা-জমি বিক্রি করার জন্য আমার (মা সন্ধ্যা রানী) গায়েও হাত তুলতো। জোর করে বাড়ির জমির দলিল নিয়ে নিত। সেই সময় তার সঙ্গে চুয়াডাঙ্গা গ্রামের আতার ছেলে তুহিন বডিগার্ড হিসেবে থাকতো।

একই অভিযোগ করেন, আব্দুল্লাহর ভাই বিপুল বিশ্বাসও। তারা অভিযোগ করেন, প্রভাতকে ধর্মান্তরিত করে জঙ্গি বানানোর পেছনে চুয়াডাঙ্গা গ্রামের লতিফই দায়ী। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে লতিফ তার মেয়েকে আব্দুল্লাহর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে।

এই তথ্য পাওয়ার পর বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিনিধি চুয়াডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল লতিফের বাড়িতে উপস্থিত হলে তার প্রতিবেশীরা জানান, বাড়িটিতে কেউ নেই। চারিদিকে ধানক্ষেত আর ফাঁকা মাঠের মধ্যে লতিফের একটি ছাপড়ির বাড়ি রয়েছে।  তার বাড়ির পাশে অন্য কারও বাড়ি-ঘর নেই। সেখানে যাওয়ার কোন রাস্তাও নেই। মাঠের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বর্ষার সময় সেখানে পানি জমে।

এলাকাবাসী জানায়, লতিফ রিকশা ও ভ্যান চালাতো। এলাকায় কারো সঙ্গে সে মিশতো না। কোন ঝামেলাতেও জড়াতো না। তবে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের খবর পেয়ে সেও পালিয়ে যায়। তবে তার স্ত্রী মাজেদা খাতুনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

এদিকে পোড়াহাটির ঠনঠনে পাড়ার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর ঝিনাইদহ সদর থানায় গত শনিবার একটি মামলা হয়েছে। আস্তানার মালিক আব্দুল্লাহ ও তার স্ত্রী ফাতেমা ওরফে রুবিনার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৮জনসহ মোট ১০ জনের নামে মামলাটি দায়ের করা হয়, যার মামলা নং ৪৯। পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) প্রবীর কুমার বিশ্বাসকে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার (২১ এপ্রিল ২০১৭) বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে পোড়াহাটি গ্রামের আব্দুল্লাহর বাড়িটি ঘিরে রাখে। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহম্মেদ ভোর ৬টা পর্যন্ত অভিযান স্থগিত ঘোষণা করেন। পরদিন অর্থাৎ ২২ এপ্রিল শনিবার সকাল সোয়া ৯ টা থেকে ‘অপারেশন সাউথ প’ শুরু করেন। অপারেশন চলাকালে ওই বাড়ি থেকে ২০ ড্রাম হাইড্রেজেন পার অক্সাইড, ১৫ টি জিহাদি বই উদ্ধার করে। এ সময় ৫ দফায় ৫টি শক্তিশালী বোমা নিষ্ক্রিয় করে বোমা ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্য।

এ অভিযানে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, র‌্যাব, পুলিশ, পিবিআই, এলআইসি, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট, খুলনা রেঞ্জ পুলিশসহ ৪ শতাধিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন।

অভিযান শেষে সেখান থেকে ২০ ড্রাম হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ১০০টি প্যাকেট লোহার বল, ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট, ৯টি সুইসাইডাল বেল্ট, বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রিক সার্কিট, ১৫টি জিহাদি বই, ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগজিন, ৭ রাউন্ড গুলি, ১টি মোটরসাইকেল, ১টি চাপাতি, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, ৬টি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট ও ২টি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয় বলে ঘটনাস্থলে এক সংবাদ সম্মেলনে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি শেখ দিদার আহম্মেদ জানান।

সংবাদ সম্মেলনের সময় খুলনা রেঞ্জের অ্যাডিশনাল ডিআইজি হাবিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুর রউফ মন্ডল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তা, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের প্রধানসহ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

 

/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তামিমের ফেরা প্রসঙ্গে শান্ত, ‘সবার আগে উনার চাইতে হবে’
তামিমের ফেরা প্রসঙ্গে শান্ত, ‘সবার আগে উনার চাইতে হবে’
পশ্চিম তীরে ২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলো ইসরায়েলি সেটেলাররা
পশ্চিম তীরে ২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলো ইসরায়েলি সেটেলাররা
রিক্রুটিং এজেন্সিকে মানবিক হওয়ার আহ্বান প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর
রিক্রুটিং এজেন্সিকে মানবিক হওয়ার আহ্বান প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর
চুয়াডাঙ্গায় বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ, তাপমাত্রা ৪০.৬ ডিগ্রি
চুয়াডাঙ্গায় বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ, তাপমাত্রা ৪০.৬ ডিগ্রি
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা