জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধন, দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি আর ৯৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলপথ নির্মাণকাজ শেষ হলেও অজ্ঞাত কারণে চালু হচ্ছে না ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় পর্যন্ত সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন। পরিবর্তে শনিবার (১৭ জুন) পঞ্চগড় থেকে শাটল ট্রেনে উদ্বোধন করতে আসছেন রেলমন্ত্রী। প্রায় সাত বছরের প্রতিশ্রুতি থেকে সরকারের সরে আসার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় এই দুই জেলায়। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন চালু না হওয়া নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছেন সাধারণ মানুষ।
আন্তঃনগর ট্রেন চালু না হওয়ায় বৃহস্পতিবার মানববন্ধন ও শুক্রবার সকাল থেকে ঠাকুরগাঁও থেকে সেতাবগঞ্জ এবং সেতাবগঞ্জ থেকে পঞ্চগড় ট্রেনমার্চ, প্রতিটি স্টেশনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশগুলো থেকে ‘শাটল ট্রেন চাই না’ , ‘অবিলম্বে আন্তঃনগর ট্রেন চালু করো’ স্লোগান দেওয়া হয়।
জানা গেছে, সরকার ৯৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থেকে ঠাকুরগাঁও হয়ে পঞ্চগড় পর্যন্ত ১৫০ কিলোমিটারের মিটার গেজ রেলপথকে আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও ডুয়েল গেজে রূপান্তর করার কাজ শুরু করে সরকার। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০১০ সালের অক্টোবরে এই কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দুই বার নির্মাণকাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে কাজ শেষ করার অঙ্গীকার করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা ও ম্যাক্র কন্সট্রাকশন।
এই প্রকল্পের ৯০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ১৩১টি ছোট ব্রিজ ও ৩টি বড় ব্রিজ পুনর্নির্মাণ, এবং মন্মথপুর, চিরিরবন্দর, কাউগাঁও, কাঞ্চন, বিরল, মঙ্গলপুর, সেতাবগঞ্জ, পীরগঞ্জ ও ভোমরাদহ রেলস্টেশন পুনর্নির্মাণ নির্মাণ শেষ হয়েছে। কিন্তু এই কাজ শেষ করতে প্রায় ৭ বছর লেগে যায়। শেষ হওয়ার পরও এই রুটে ঢাকাগামী ব্রডগেজ লাইনের ট্রেন চলাচল শুরু করা সম্ভব হয়নি।
ঠাকুরগাঁও ভোমরাদহ এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম জানান, ‘আমরা গত ৭ বছর ধরে আশায় বুক বেঁধে আছি আন্তঃনগর ট্রেন চালু হবে। সরকার প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেল লাইন নির্মাণ করলো। কিন্তু এখন ট্রেন চালু হলে করার ব্যাপারে কেন এই টালবাহানা ?’
সদর উপজেলার পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিন অভিযোগের সুরে বলেন, ‘ঠাকুরগাঁও বন্যামুক্ত কৃষিপ্রধান এলাকা। খরা ছাড়া সাধারণত আমাদের কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয় না। প্রচুর পরিমান ধান, গম, ভুট্টা, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হয় এ জেলায়। বাইরে থেকে পাইকার আসলে পরিবহন খরচের কারণে উৎপাদিত ফসলের নায্যমূল্য পাই না আমরা। মনে করেছিলাম ঢাকার সঙ্গে সরাসরি ট্রেন চালু হলে আমাদের জেলার কৃষি পণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কম খরচে পাঠানো সম্ভব হবে। কিন্তু কী কারণে সরকার এই অঞ্চলে ট্রেন চালু করছে না ?’
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি ও রেল আন্দোলনের অন্যতম নেতা ওবায়দুল্লাহ মাসুদ জানান, ‘গণমানুষের দাবি উপেক্ষা করে ট্রেন চালু হলে লোকসান গুনতে হবে এমন অজুহাতের কথা উঠিয়ে ট্রেন চালু করছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করছি দ্রুত আন্তঃনগর ট্রেন চালু করে অবহেলিত ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের মানুষের দাবির বাস্তবায়ন ঘটান। নাহলে দীর্ঘদিনের অনুন্নয়নের ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।’
ঠাকুরগাঁওয়ের হাজী সংগঠনের সংগঠক প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল লতিফ বলেন, ‘এ জেলার নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তরে গণমানুষের দাবি তুলে ধরতে। আর তাই মেনে নেওয়া ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটা পরিকল্পনাকে পরিবর্তন করতে সাহস করছে প্রশাসন। এ জেলায় কোনও মেডিক্যাল কলেজ , প্রকৌশল কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিছুই করা হয়নি। চালু বিমানবন্দর অকেজো করা হয়েছে। আর আজ প্রতিশ্রুতি দিয়েও , কাজ শুরু করেও আন্তঃনগর ট্রেন চালুর জনসাধারণের আশাকে কবর দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদি এভাবেই হয় তবে নিজেদের দাবি পূরণ করতে জনসাধারণ যা করণীয় তাই করবে।’
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক রেজওয়ানুল হক রিজু বলেন, ‘আমরা আন্তঃনগর ট্রেন ছাড়া অন্য কিছু মানবো না। অবহেলিত এ জনপদের প্রত্যেকটি ন্যায্য দাবি আদায় করা হবে।’
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল জানান, ‘জেলার মানুষের কথা বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে আন্তঃনগর ট্রেন চালুর বিষয়ে আবেদন করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আবারও আবেদন করা হবে।’
/এফএস/
আরও পড়ুন-
