বিদ্যুৎ আইন বলছে, ‘হাই-ভোল্টেজ’-এর সঞ্চালন লাইনের নিচে কোনও ঘরবাড়ি বা স্থাপনা থাকতে পারবে না, ডানে ও বামে অন্তত ১০ ফুট ফাঁকা থাকতে হবে। কিন্তু এসবের কিছুই মানা হচ্ছে না কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়া এলাকায়। সেখানে বহু বাসাবাড়ির ওপর বিপজ্জনকভাবে ঝুলে রয়েছে ৩৩ হাজার ভোল্টেজের সঞ্চালন লাইনের তার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কোনও কোনও বাড়ির ছাদ ও চালেরও ওপরে বিদ্যুতের লাইন ছুঁই ছুঁই করছে। ঝুঁকিপূর্ণ এ বিদ্যুৎ লাইনে গত তিন বছরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ২০ থেকে ২২ জন হতাহত হলেও, বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে কোনও ভূমিকাই নেই। এলাকাবাসী বাড়িঘরের ছাদ ছুঁই ছুঁই এমন উচ্চ ভোল্টেজের সঞ্চালন লাইন সরিয়ে নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এতে সাড়া দিচ্ছে না। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে বাস করছেন এলাকাবাসী।
জানা গেছে, অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগে নান্দাইল ফিডার নামে পরিচিত ৩৩ হাজার ভোল্টেজের এ লাইনটি স্থাপন করা হয়। তখন এলাকায় বাসাবাড়ি তেমন ছিল না। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠে। ওই উচ্চ ভোল্টেজের তারের নিচেই অসংখ্য বাসাবাড়ি করে লোকজন। স্থানীয়দের অভিযোগ, ধীরে ধীরে লাইনের তার ঝুলে পড়লেও দীর্ঘদিনেও এই সঞ্চালন লাইনের মেরামত বা সংস্কার হয়নি। বর্তমানে লাইনটি অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ লাইনে দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন নগুয়ার বাসিন্দারা।
আখড়া বাজার এলাকার বাসিন্দা লাল মিয়া(৬০)। তাঁর ১২ বছর বয়সী ছেলে সুজন কাজ করতো শহরের একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজে। তিন মাস আগে নগুয়া এলাকার একটি বাসার চাল থেকে ঘুড়ি কুড়িয়ে আনতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয় সে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সুজন। চিকিৎসায় কয়েক লাখ টাকা খরচ হলেও ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি লাল মিয়া।
হারুয়া এলাকার আদল মিয়ার একমাত্র ছেলে মাদ্রাসাছাত্র মোহাম্মদ সাগরও একইভাবে একই এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় চার মাসে আগে। তারও একমাস আগে গাছের ডাল কাটতে গিয়ে বিদ্যুতের তারের স্পর্শ লেগে মারা যান এক নারী গৃহকর্মী।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া সুজনের বাবা লাল মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারেন্টের (বিদ্যুতের) তার এই এলাহার বেশিরভাগ ঘরবাড়ির চাল লাগে লাগে অবস্থা। এমন একটি ঘরের চাল থাইক্যা ঘুড্ডি আনত গিয়াই আমার ছ্যারাডা (ছেলে) ফুইরা (পুড়ে) মরছে। কিন্তু এইতা লাইয়া কারো মাথাব্যতা (মাথাব্যথা) আছে বইল্যা আমার মনে অয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছ্যারা ছাড়াও কত মানুষ যে লাইনে শট খাইতাছে তার কোনও হিসাব নাই।’
এলকাবাসীর দাবি, গত তিন বছরে নগুয়া এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হতাহত হয়েছে অন্তত ২০ থেকে ২২জন লোক। এদের মধ্যে মারা গেছে ১০জন। মাসখানেক আগে ঘরের ছাদে বিদ্যুতের তার লেগে সরকারি এক কর্মকর্তার বাসাসহ পুড়ে যায় বেশ কয়েকটি বাসার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি। মাঝে মাঝেই ঘটছে এ ধরনের দুর্ঘটনা।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত শিশু সাগরের বাবা আদল মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখানে গত ছয় মাসে আমার ছেলেসহ পাঁচ-ছয়জন মানুষ মারা গেছে। পঙ্গু হয়েছে আরও বেশকিছু লোক। কিন্তু এত দুর্ঘটনারও পর তারগুলো সরানো হচ্ছে না এলাকা থেকে।’
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ‘নগুয়া এলাকা দিয়ে ৩৩ হাজার ভোল্টেজের যে সঞ্চালন লাইনটি ময়মনসিংহের নান্দাইলে গেছে, সেটি লোকজনের বাড়িঘরের ছাদ বা টিনের চাল ছুঁই ছুঁই করছে। লাইনের ডান-বামের পরিস্থিতি আতঙ্কিত হওয়ার মতো। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা দিয়ে বিদ্যুতের উচ্চ ভোল্টেজের লাইন যাওয়ায় অনেকে বাসাবাড়ি নির্মাণ করতে পারছেন না। আবার অনেকে বাসার কাজ শেষ করতে পারছে না। এ কারণে জায়গা জমি থাকার পরও অনেকের জমি পতিত পড়ে আছে। কেউ আবার অনেক কষ্টে কেনা জায়গা বেচে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
স্থানীয়রা জানান, কয়েক বছর আগে ছাতা নিয়ে একতলা বাসার ছাদে কাজ করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন মকবুল হোসেন। তিনি প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ করে সুস্থ হন। এখন ছাদে উঠার সিঁড়িটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু এ পরিবার নয়, এলাকার বহু পরিবার রীতিমতো জীবনবাজি রেখে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুতের তারের নিচে বাসাবাড়িতে বসবাস করছেন।
এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী ফারুক আহমেদ বাচ্চু জানান, তাঁর বাসার চালের দুই থেকে আড়াই ফুট ওপরেই ৩৩ হাজার ভোল্টেজের লাইন। কিছুদিন আগে এখানে এক নারী গৃহকর্মী নারিকেল পাড়তে গিয়ে মারা যায়। আরো বেশ কিছু দুর্ঘটনা হয়েছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
আর.এস আইডিয়াল কলেজের প্রভাষক সেলিম জাভেদ বলেন, বছরখানেক আগেও আমার বাসার ওপর লাইনটি প্রায় আট ফুট উপরে ছিল। এখন এগুলো ঝুলে পড়ে দুই ফুটের কাছাকাছি চলে এসেছে। আমার বাসার ওপরেই একটি ছেলে মারা গেছে। আহত হয়েছে আরও ছয়জন। গত কয়েক বছরে অন্তত ২০-২২ জন হতাহত হয়েছে এলাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাইনের মালিকানা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা পিডিবির হলেও এটি বর্তমানে ব্যবহার করছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। তাই জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লেও কোনও পক্ষই এ লাইন মেরামতের দায়িত্ব নিচ্ছে না। বরং দুই পক্ষে এ সঞ্চালন লাইনটি নিয়ে চলছে চাপান-উতোর।পিডিবি বলছে, এ লাইনটি বর্তমানে ব্যবহার করছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তাই এটির রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের দায়িত্ব তাদের। অন্যদিকে, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে বলা হচ্ছে, লাইনটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ব্যবহার করলেও তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
কিশোরগঞ্জ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. উবাদুল ইসলাম বলেন, ‘বহু আগে থেকেই এ লাইনটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ব্যবহার করছে। যেহেতু তারা ব্যবহার করছে তাই এটি ঝুঁকিমুক্ত করে ব্যবহার করা উচিত।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড কিশোরগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী অসিত কুমার ভৌমিক বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ শহর থেকে নান্দাইল ফিডারে যে ৩৩ হাজার ভোল্টেজের লাইন গেছে, বহুবার চিঠি দেওয়ার পরও পিডিবি পল্লী বিদ্যুতের কাছে তা হস্তান্তর করেনি। ফলে লাইনটিতে বড় ধরনের মেরামত বা সংস্কার কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
/টিএন/আপ-এসএনএইচ/