X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনাহার-হাহাকারে কেটে গেল হাওরবাসীর ঈদ

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, সুনামগঞ্জ
২৬ জুন ২০১৭, ২০:২৪আপডেট : ২৬ জুন ২০১৭, ২০:৫৭

যেমন কাটলো হাওরবাসীর ঈদের দিন

পরনে পুরনো কাপড়, ঘরে ফিরনি সেমাইয়ের বদলে আটার রুটি, কারও কারও উনুনে আগুনও জ্বলেনি। এমন অর্ধাহার-অনাহার আর হাহাকারে আজ সোমবার ঈদ পার করলেন সুনামগঞ্জের হাওরবাসী।

তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের ছিলাইন তাহিরপুর গ্রাম।  টাঙ্গুয়ার হাওর ও মাটিয়ার হাওর বেষ্টিত গ্রামটির পাশে আছড়ে পড়ছে হাওরের বড়বড় ঢেউ। ঢেউয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ চারদিক সুরমূর্ছনা তৈরি করলেও গ্রামের সুজনারা বেগম, রাসু আক্তার, তফুরা খাতুন সামারুন, সেনোয়ারাদের মনে তা নতুন কোনও উদ্দীপনা তৈরি করে না। এই গ্রামজুড়ে ঈদুল ফিতর যেন কেবল টেনে বয়ে যাওয়া আরেকটি দিন।

যেমন কাটলো হাওরবাসীর ঈদের দিন

গ্রামটি ঘুরে দেখা গেছে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। নেই কোনও আনন্দ। ঘরে চাল নেই, তাই হাঁড়িতে ভাতও নেই। ঈদের দিন সকালে হাওরের স্বচ্ছ জলে গোসল করে পুরোনো কাপড় পড়ে ফিরনি সেমাইয়ের বদলে বানাচ্ছেন আটার রুটি। তাদের সন্তানদের গায়ে ওঠেনি কোনও নুতন জামা। গেলবারের পুরোনো কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে ছেলে-মেয়েদের পরতে দিয়েছেন। গ্রামের পুরুষ লোকেরা জনাজীর্ন মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। ঈদের নামাজ শেষে হাওরের বিশাল জলরাশির দিকে চেয়ে থাকেন আশ্রব আলী যদি কেউ ত্রাণ বা সাহায্য নিয়ে আসে এ আশায়। কিন্তু সকাল গড়িয়ে বিকেল হলেও কেউ কোনও সাহায্য নিয়ে আসেনি তাদের জন্য। পুরো দিন কাটে সাহায্যের আশায় থেকে।

যেমন কাটলো হাওরবাসীর ঈদের দিন

গ্রামের ৩৪ বৎসরের যুবক ইমান নূর বলেন, জোড়া তালির লুঙ্গি আর শার্ট পড়ে তিনি ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। ১০০ ঘরের ঘন বসতিপূর্ণ এই গ্রামে ৭০০ লোকের বসবাস। তাদের কারও গায়ে ওঠেনি নুতন জামা। কারও ঘরে একবেলা রান্নার চালও নেই। হাওরে ঈদের দিনে হাহাকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। অকাল বন্যায় হাওরবাসীর ঈদ আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। হাওরের সবুজাভ পানি আর চোখের নোনা জল মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। হাওরের জলে এখন দুঃখ বেদনার ঢেউ খেলে। গ্রামের বেশির ভাগ লোক কৃষি ও মৎস্যজীবী। বর্ষায় রাতে হাওরে জাল ফেলে মাছ ধরে আর সকালে মাছ বিক্রি করে জীবন চলে। গ্রামের সবাই মাস দুয়েক আগেই সুখের স্বপ্ন রচনা করেছিলেন কিন্তু বন্যা আর বানের পানি তাদের আনন্দ উৎসব মাটি করে দিয়েছে।

যেমন কাটলো হাওরবাসীর ঈদের দিন

ছিলাইন তাহিরপুর থেকে নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়া যায় না। চারদিকে পানিবেষ্টিত ৭ কেয়ার জায়গা জুড়ে এ গ্রামে স্থলভাগ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। হাওরের পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চলাচল সীমিত হয়ে যায়। একশ’ ঘর গ্রামের একটি ঘরও পরিপাটি ভাবে সাজানো গোছানো নেই। প্রত্যেকের বাড়ির ছাদ বা বেড়ায় অসংখ্য ছিদ্র। গ্রামবাসী ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে বোঝা যায় যে গ্রামবাসীর সবাই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছেন। নারী-পুরুষ শিশু কিশোর কিশোরী কারও স্বাস্থ্য ভালো নেই। লিকলিকে অপুষ্টিতে আক্রান্ত চেহারা নিয়ে মানুষগুলো কোনোরকমে টিকে আছে। মাছ ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন হাওরের পানি বেড়ে যাওয়ায় এখন আর পর্যাপ্ত মাছ ধরতে পারেন না তারা। তাই নিত্য অভাব ঘরের কোণে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

যেমন কাটলো হাওরবাসীর ঈদের দিন

গ্রামের আবু শামা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আল্লাহ হাওরবাসীর ওপর আর যেন এরকম গজব না দেয় ঈদের জামাতে এ দোয়াই করেছি। গ্রামের রতিবুল নেছা বলেন, ‘ঈদের দিন তাদের চুলায় আগুন জ্বলেনি। কারণ, ঘরে একমুঠো চালও নেই।’ সেনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘হাওরের মধ্যে পানি আর পানির মধ্যে তাদের বসবাস। বিচ্ছিন্ন জনপদ হওয়ায় তাদের খোঁজ খবর কেউ রাখে না।

তিনি বলেন, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ সরকারি বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা পায়নি। রতিবুল নেছা বলেন তার দীর্ঘ ৫০ বছরের জীবনে এরকম অভাব আর এরকম ঈদ কোনোদিন দেখেননি। খেয়ে না খেয়ে ঈদের দিন কাটছে তাদের, আশঙ্কা করেন, এভাবেই হয়তো সারা বছর কাটাতে হবে।

যেমন কাটলো হাওরবাসীর ঈদের দিন

সকাল ৯ টায় তাহিরপুর সদর উপজেলার শনির হাওর তীরবর্তী উজান ও মধ্যতাহিরপুর ঈদগাহে গিয়ে দেখা যায়, ঈদের জামাতের বেশির ভাগ লোকের গায়ে নুতন জামা কাপড় ওঠেনি। সবাই গেলবারের পুরোনো শার্ট পাঞ্জাবি পরে নামাজে অংশগ্রহণ করেছেন। শিশুদেরও একই অবস্থা। উজান তাহিরপুর গ্রামের বেশ কিছু ঘরবাড়ি ঘুরে দেখা যায় কারও কারও রান্নাঘরে আগুন জ্বলেনি। অভাবের যন্ত্রণায় একরাশ কালো মেঘ নিয়ে বউঝিয়েরা সংসারের কাজ করছেন।  সুজানা বেগমের তিন ছেলে ৩ মেয়ে। তাদের কারও গায়ে নুতন জামা নেই।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, সরকারি বেসরকারি সাহায্য অপ্রতুল থাকায় ঈদের দিনে সবাইকে সাহায্য সহযোগিতা করা যায়নি। তিনি হাওরবাসীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে নিজেও গেল বারের পাঞ্জাবি পরে ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করেছেন।  তিনি সরকারি সাহায্য বাড়ানোর দাবি জানান সরকারের কাছে।

/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!