X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

একজন জহিরন বেওয়ার গল্প

মোয়াজ্জেম হোসেন, লালমনিরহাট
২১ জুলাই ২০১৭, ০৯:২৩আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৭, ০৯:৩৯

নিজের বাড়ির সামনে জহিরন বেওয়া তার বয়স ৭০ বছর। তার ছোট ছেলে তোরাব আলীর বয়স যখন ছয়-সাত মাস, তখনই স্বামী ছাহেদ আলী মারা যান। তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে অভাবের সংসারের হাল ধরতে হয় তাকেই। এ জন্য তাকে হতে হয়েছে ‘ধাত্রী সেবিকা’। জীবনের মাঝামাঝি সময়ে ধাত্রী পেশা ছেড়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টাও করেন তিনি। কিন্তু তা হতে না পেরে ধাত্রী সেবিকার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে পাড়া-মহল্লায় জ্বর, সর্দি, কাশি ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের শারীরিক দুর্বলতার কবিরাজিও করেন। ৭০ বছর বয়সেও বাইসাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ‘চিকিৎসা’ দিয়ে বেড়ান তিনি। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার এই বৃদ্ধাকে একনামে সবাই ‘নানি’ বলেই ডাকেন। তিনি জহিরন বেওয়া। স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে ঘুরে ফেরে তার জীবনের গল্প।
আদিতমারীর ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা তালুক বারঘড়িয়া এলাকায় থাকেন জহিরন বেওয়া। জেলা শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এই বাড়ি। ছোট ছেলে তোরাব আলীর সঙ্গে থাকেন। চাতালের পশ্চিম দিকে থাকা টিনশেড ও হাফ ওয়াল কাঁচা মেঝের একটি কক্ষে থাকেন তিনি।
গ্রামের রাস্তায় সাইকেল নিয়ে জহিরন বেওয়া জহিরন বেওয়ার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ১৯৭৩ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের কোনও একদিন জহিরনের স্বামী ছাহেদ আলী মারা যান। অভাবের সংসার চালাতে প্রায়ই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সোবাহানের কাছে যেতেন তিনি। জহিরন বেওয়ার সম্পর্কে মামা হন ভেলাবাড়ীর প্রয়াত সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সোবাহান। আশির দশকের দিকে সেই চেয়ারম্যানের অনুরোধে স্থানীয় পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী রেহেনা খাতুনের মাধ্যমে ধাত্রী সেবিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন জহিরন। সেখানেই কাজ করতে গিয়ে কিছু রোগ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানও অর্জন করেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি এখন বাড়ি বাড়ি ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি কবিরাজিও করেন।
সরেজমিনে ঘুরে আদিতমারীর অনেকের সঙ্গেই কথা হয় জহিরন বেওয়া সম্পর্কে। তারা সবাই তাকে ‘নানি’ বলে ডাকেন তাকে। তার কাছ থেকে গ্যাস্ট্রিক, জ্বর, সর্দি, কাশির ওষুধ টাকার বিনিময়ে নিয়েছেন এমন অনেককেই পাওয়া গেল। কেউ কেউ হাঁস-মুরগির ওষুধ নেওয়ার কথাও জানান।
২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল অবসরে যাওয়া পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী রেহেনা খাতুন বলেন, ‘জন্মবিরতি, বন্ধ্যাকরণ, জন্মবিরতির বড়ি ও কনডম পদ্ধতি সম্পর্কে গ্রামে প্রচারণার জন্য ১৯৮০ সালের দিকে সরকারিভাবে প্রত্যেক এফডব্লিউএ কর্মীকে একজন করে দাই (ধাত্রী) সঙ্গে নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় সোবহান চেয়ারম্যানের অনুরোধে জহিরনকে দাই হিসেবে নেওয়া হয়। পরে ১৯৯৫ সালের দিকে এসব দাইকে বাদ দেওয়ার জন্য সরকারি নির্দেশনা এলে তাকেও কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। পরে তিনি সংরক্ষিত নারী সদস্য ও চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য নির্বাচনেও অংশ নেন। তবে জিততে পারেননি তিনি। পরে জহিরন বেওয়া নিজ উদ্যোগে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের চিকিৎসার পাশাপাশি মানুষের বিভিন্ন রোগের ওষুধ বিক্রির কাজ শুরু করেন। মাঝে-মধ্যে ছেলে-মেয়েদের কিছু দুর্বলতার বিষয়ে কবিরাজিও করেন। ১৯৯৫ সালের পর থেকে তিনি সাইকেল চালিয়ে নিজ উদ্যোগে এসব কাজ করছেন।’
প্রতিবেশীদের সঙ্গে জহিরন বেওয়া স্থানীয় দুলালী পাগলারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল বাসার বলেন, ‘জহিরন বেওয়া চিকিৎসা করেন না। তিনি জ্বর, সর্দি, কাশি ও গ্যাস্ট্রিকে ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, গরুর অসুখে ওষুধ দিয়ে থাকেন। এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি যে কাজটি করছেন, তা সত্যিই নজিরবিহীন।’
কথা হয় জহিরনের ছোট ছেলে তোরাব আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মায়ের বয়স হয়েছে। এই বয়সে এসে এভাবে সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ওষুধ বিক্রি না করতে বলে যাচ্ছি। কিন্তু তিনি এই কাজ ছাড়তে চান না। তাকে থামানো যাচ্ছে না।’
আলোচিত বৃদ্ধা জহিরন বেওয়া বলেন, ‘দাইয়ের কাজ করেছি। পরে ভেলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করি। ৯০০ ভোটে ফেল করলে আর ভোট করিনি। পরে সাইকেল চালিয়ে ছেলেমেয়েদের গোপন অসুখের কবিরাজি চিকিৎসার পাশাপাশি জ্বর, সর্দি, কাশির ওষুধ গ্রামে গ্রামে বিক্রি করি। এছাড়াও আমি হাঁস-মুরগি, ছাগল-গরুরও চিকিৎসা করি। যতদিন শক্তিতে কুলায় ততদিন মানুষকে এভাবে সেবা বিলিয়ে দিয়ে যাবো।’
আরও পড়ুন-

তীর রক্ষা বাঁধে ৯ম দফায় ধস, হুমকির মুখে চৌহালী

হিলি স্থলবন্দরে পেঁয়াজের দাম কেজিতে কমেছে ২-৩ টাকা

/এএম/টিআর/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
সর্বাধিক পঠিত
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!