X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুঁকি যত বেশি, টাকা তত কম

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
২২ জুলাই ২০১৭, ১২:১৫আপডেট : ২২ জুলাই ২০১৭, ১৫:৫৪

জঙ্গল সলিমপুর সমতলে জমি কিনলে একরকম দাম। আর পাহাড়ের ঢালে অন্যরকম। সমতলে এক লাখ হলে একটু উঁচুতে পাহাড়ের ঢালের দিকে তা হয় ৮০ হাজার টাকা। আরেকটু দূরে গেলে আরও কমে, যেমন ৬০ হাজার টাকা। আর পাহাড়ের ঢালে গেলে আরও কম। সেখানে প্লট মিলবে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। সীতাকুণ্ডের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা জঙ্গল সলিমপুরে গড়ে ওঠা ছিন্নমূল বস্তিতে এ নিয়মেই চলছে জায়গা বেচাকেনা। এখানে সরকারি জায়গা অবৈধভাবে দখল করে অবাধে বিক্রি করছেন ভূমিদস্যুরা। বিভিন্ন সংগঠনের নামে গত দুই যুগ ধরে বিভিন্ন উপায়ে তারা বিক্রি করছেন সরকারি জায়গা। শুক্রবার দুই শিশুসহ পাঁচ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ওই এলাকায় গেলে এই তথ্যই জানিয়েছেন স্থানীয়রা। জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড় ধস

এলাকাবাসী জানান, নব্বইয়ের দশক থেকে জঙ্গল সলিমপুরে সরকারি জায়গা ক্রয়-বিক্রয় শুরু হয়। শুরুতে ছিন্নমূল বস্তিবাসি সমন্বয় পরিষদের ব্যানারে গঠিত সংগঠনের সদস্যপদ নিয়ে নামমাত্র মূল্যে জায়গার দখল সত্ত্ব পেতেন বসবাসকারীরা। পরে শুরু হয় টাকার বিনিময়ে দখলসত্ত্ব বেচা-কেনা। ২০০৪ সালে এটি ব্যাপক আকারে শুরু হয়। তখন কয়েকজন প্রভাবশালী ভূমিদুস্য পেশীশক্তি দেখিয়ে জায়গা বেচা-কেনা শুরু করেন।

আব্দুর রহিম নামে ওই এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘২০০৪ সাল থেকে এখানে ব্যাপক আকারে জমি ক্রয়-বিক্রয় শুরু হয়। তখন সামান্য টাকার বিনিময়ে একটি প্লট পাওয়া গেলেও এখন জায়গার অবস্থানগত সুযোগ-সুবিধার ওপর নির্ভর করে প্লটের মূল্য নির্ধারিত হচ্ছে। যে জায়গা যত বেশি সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে ওই জায়গার দাম তত বেশি। আবার যেই জায়গা পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকিপূর্ণ, ওই জায়গার দামও কম।’ জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড় ধস

তিনি বলেন, ‘সমতলে সড়কের আশপাশে থাকা প্রতিটি প্লট বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকায়। অন্যদিকে পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় প্লট বিক্রি হচ্ছে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায়।’

লটকন শাহ মাজার সংলগ্ন তিন নম্বর সমাজের বাসিন্দা নুর নবী বলেন, ‘একটি প্লট কিনতে এখন  এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। ওই টাকা দিলে প্লটের দখল সত্ত্ব পাওয়া যায়।’

ফেরদৌস নামে চন্দনাইশ এলাকার বাসিন্দা বলেন, ‘এখানে আমার একটি প্লট আছে। ২০১৩ সালে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে এটি কিনি। এখন প্লটটি ৫ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা যাবে।’ জঙ্গল সলিমপুরে ঝুকিপূর্ণ অবস্থানে ঘরবাড়ি

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আলী আক্কাসের তত্ত্বাবধানে ২০০৪ সালে এখানে ব্যাপক আকারে বসতি শুরু হয়। তখন আক্কাস নামমাত্র মূল্যে জায়গার দখলসত্ত্ব বিক্রি শুরু করেন। আর দখল করতে শুরু করেন একের পর এক পাহাড়। সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ কাউকেই কোনও তোয়াক্কা না করে ওই সময় পাহাড়ের প্রবেশ পথে একাধিক গেট দিয়ে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন আক্কাস। এমনকি সেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তখন প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

পরবর্তীতে র‌্যাব গঠনের পর আক্কাস কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। র‌্যাব সেখানে কয়েক দফা অভিযানের পর এক পর্যায়ে ২০১০ সালের ২৩ মে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে আলী আক্কাস মারা যান। এতে কিছুদিন সেখানে দখলবাজি থামলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আবার বাড়তে থাকে। বর্তমানে সেখানে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে কিছু ভূমিদস্যু চক্র আগের মতোই তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রকাশ্যে বেচাকেনা করছে জায়গার দখলসত্ত্ব। তবে অভিযোগ রয়েছে, ওই ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারছে না প্রশাসন। জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড় ধস

এ নিয়ে সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন সীতাকুণ্ড উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া। ওই সভায় তিনি বলেন, ‘কয়েকজন ভূমিদস্যুর তত্ত্বাবদানে হাতিয়া, সন্দ্বীপ, নোয়াখালী, ফেনীসহ আশপাশের এলাকার প্রায় ১০ হাজার ছিন্নমূল মানুষ জঙ্গল সলিমপুরে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে।  এলাকাটি এতই দুর্গম যে চাইলেও অতি অল্প সংখ্যক পুলিশ বা অন্য বাহিনী সেখানে অভিযান চালাতে পারে না। সেখানে অভিযান চালাতে গেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশাল ফোর্স প্রয়োজন। এছাড়া এলাকাটি বিশাল হলেও প্রতকূল পরিস্থিতির কারণে সেখানে ঠিক কত একর পাহাড় রয়েছে এবং বর্তমানে ওই এলাকার বাসিন্দা কত তার সঠিক কোনও পরিসংখ্যানও নির্ধারণ করা যায়নি।’

তবে চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসি সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের বর্তমান সভাপতি গাজী মো. সাদেকুর রহমান জানিয়েছেন, ওই এলাকায় ২০ হাজার পরিবার বসবাস করছে। তিনি বলেন, ‘এখানে সব জেলার মানুষই আছে। দিনমজুর, হোটেল বয়, গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, ঠেলাগাড়িচালক- যাদের কোথাও থাকার জায়গা নেই তারাই এখানে থাকছেন। আমরা চাই সরকার বন্দবস্ত দিয়ে তাদের এখানে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিক।’

সাদেকুর রহমান বলেন, ‘গত বছর ছয়শ একর জমির বন্দবস্ত চেয়ে আমরা আবেদন করেছি। ওই সময় আমরা এখানে বসবাসকারী ২৪ হাজার মানুষের একটি তালিকাও জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়েছিলাম।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ওই এলাকার ভেতরে চারটি মাদ্রাসা, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, তিনটি কেজি স্কুল, তিনটি এতিমখানা, ১২টি মসজিদ, ৫টি মন্দির, একটি গির্জা, ছয়টি কবস্থান, একটি শ্মশান ও একটি কাঁচা বাজার রয়েছে। প্রতিটি ঘরে রয়েছে বিদ্যুতের বৈধ সংযোগ। জঙ্গল জলিমপুরে পাহাড় ধস

সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি টেনে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের লাইন পৌছে দেওয়া হয়েছে। ওই পাহাড়ে বসবাসকারী প্রায় সবার ঘরে বিদ্যুতের মিটার রয়েছে। গড়ে উঠেছে বড় বড় দালান। ওই এলাকায় দ্বিতল ভবন দেখা গেছে। মোবাইল কোম্পানির বিটিএসও স্থাপন করা হয়েছে ওই এলাকায়।

তিন নম্বর সমাজের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘এলাকায় কয়েকজন টাকা খরচ করে গভীর নলকুপ স্থাপন করেন। পরে তারা অন্য বাসাগুলোতে পানি সরবরাহ করেন। পানি নিতে প্রতিমাসে একটি পরিবারকে ৬০০ টাকা খরচ করতে হয়। একদিন পর একদিন বন্ধ রেখে প্রতিমাসে ১৫দিন পানি সরবরাহ করা হয়।’ জঙ্গল জলিমপুরে পাহাড় ধস

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এটা বসবাসের জায়গা না। এখানে বিদ্যুৎ আসার কথা না, কিন্তু এসেছে। এখানে যারা বাস করছেন তারা অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তারা কিভাবে এখানে বসতি গড়েছে আপনারা জানেন। তাদেরকে সরকারি জায়গা ছেড়ে দিতে। অবশ্যই তাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিতে হবে। তখন তারা আপনাআপনি চলে যাবে। আর একজনকে চলে যেতে দেখলে অন্যরাও আস্তে আস্তে চলে যাবে।’

/এফএস/

আরও পড়ুন- 

রাজপ্রাসাদ বানিয়ে দিলেও ওখানে থাকতাম না!
‘বুদ্ধ জানে আর কতদিন এভাবে থাকতে হবে’

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা