X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি চাল পাচার: কর্মকর্তাদের যত ভূমিকা

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
২৩ জুলাই ২০১৭, ০৮:০০আপডেট : ২৩ জুলাই ২০১৭, ০৯:৫৬

জব্দ করা চালের ট্রাক তিনি সরকারি খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা। আবার স্ত্রী-সন্তানের নামে নেওয়া লাইসেন্স দিয়ে তিনিই পরোক্ষভাবে ঠিকাদারী করছেন। শুধু তাই নয়, খাদ্য গুদামে ব্যবসায়ীদের কেনা চাল রেখে নিজে গুদামের মালিক সেজে আদায় করেন ভাড়া। অভিযোগ রয়েছে, ফখরুল আলম নামের এই কর্মকর্তা নিজেই ব্যবসায়ীর ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হন। সরকারি চাল কারসাজির মাধ্যমে কিনে বেশি দামে বিক্রি করেন কালোবাজারে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে সরকারি চাল পাচারের ঘটনায় তদন্ত নেমে এমন তথ্যই পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।  সরকারি খাদ্যগুদামে কর্মরত ফখরুলের মতো এরকম কিছু অসাধু কর্মকর্তার ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় অবর্তীণ হয়ে সরকারি চাল পাচারের তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে। 

তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি চাল উদ্ধারের পর প্রাথমিক অনুসন্ধানে আমরা জানতে পেরেছি, সরকারি চাল গুদামেই থাকে। প্রকল্পের বরাদ্দ, পরিবহন, ভি-ইনভয়েস, ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) ইত্যাদি কাগজে-কলমে চালাচালি হয়। পরে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে গুদাম থেকে চালগুলো বের করেন কর্মকর্তারা। এর সঙ্গে কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের একটি অসাধুচক্র জড়িত থাকেন।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি সরকারি চাল কালোবাজারে ছাড়ার ক্ষেত্রে খাদ্য বিভাগের কিছু কর্মকর্তা আত্মীয়স্বজনের নামে লাইসেন্স নিয়ে ঠিকাদারের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হন। তারা মাঝে মাঝে নিজেরাই চালগুলো কিনে কালোবাজারে বেশি দামে ছাড়েন বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে।' খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাল জব্দ মামলার পলাতক আসামি হালিশহর গুদামের সহকারী ব্যবস্থাপক ফখরুল আলম নিজেও ঠিকাদারী এবং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, ফখরুলের স্ত্রী সালেহা আলমের নামে সুহৃদ ইন্টারন্যাশনাল, ছেলে সাজিদের নামে মেসার্স সাজিদ এন্টারপ্রাইজ, বাবা আবুল কালামের নামে মেসার্স কালাম অ্যান্ড সন্স ও আত্মীয় আবু নাছেরের নামে ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজসহ একাধিক সদস্যের নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স নিয়েছেন। দুটি ট্রাকও আছে তার।

অভিযোগ রয়েছে, খাদ্য অধিদফতরের এই কর্মকর্তা সরকারি দায়িত্বপালনের পাশাপাশি তার স্ত্রী, আত্মীয়স্বজনের নামে খাদ্য পরিবহনের লাইসেন্স নিয়ে পরোক্ষভাবে ঠিকাদারের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়ে ঠিকাদারের টাকাও নিজে নিয়ে নিতেন। আবার সরকারি চাল কালোবাজারে বিক্রির পর ওই চাল গুদামে রেখে ভাড়াও আদায় করতেন।

গত সোমবার বিকালে নগরীর হালিশহর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৫৫ মেট্রিক টন সরকারি চাল উদ্ধার করে র‌্যাব-৭। পরদিন আকবর শাহ এলাকায় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় ১৩ মেট্রিক টন। অভিযানে হালিশহর সিএসডি খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক প্রণয় চাকমাসহ পাঁচ জনকে আটক করা হয়। পরে ওই ঘটনায় দুটি পৃথক মামলা দায়ের করে র‌্যাব। র‌্যাবের ওই মামলায় প্রণয় চাকমা ও ফখরুল আলমকে অন্যতম আসামি করা হয়।

গ্রেফতারের পর প্রণয় চাকমা স্বীকার করেছেন, গুদামের চাল পাচার করা হচ্ছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে তা অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়েছিল।

প্রণয়নের ভাষ্যের সূত্র ধরে তদন্ত চালিয়ে সরকারি চালের অবৈধ বাণিজ্যের বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে র‌্যাব-পুলিশ। তারা বলছে, চাল পাচারের সঙ্গে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত। চাকরির পাশাপাশি তারা ঠিকাদারী এবং ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছেন। তাদের সঙ্গে এ কাজে হাত মিলিয়েছে খাদ্য বিভাগের ঠিকাদার এবং চট্টগ্রামের অসাধু চাল ব্যবসায়ীরা। এই চক্রটি গুদামের চাল গুদামে রেখেই ভি-ইনভয়েস (পরিবহন চালানপত্র) এবং ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) ইস্যু করে মুখে মুখে সব কাজ চলে। পরে সুযোগ বুঝে গুদাম থেকে চাল পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের কাছে। সরকারি খাদ্যশস্য প্রকল্পের বিপরীতে নির্দিষ্ট জেলা বা উপজেলায়ও পাঠানো হয় না। পরিবহনের টাকা তারা নিজেদের মধ্য ভাগ করে নেয়।

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা সুস্পষ্ট যে, সরকারি চাল পাচারের সঙ্গে কর্মকর্তারাই জড়িত। ১৫৫ মেট্রিক টন চাল জব্দের ঘটনায় গ্রেফতার হালিশহর সিএসডি খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক প্রণয় চাকমা নিজেও জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। চালগুলো কোনও সংস্থার না। সেনাবাহিনী, র‌্যাবসহ সকল সংস্থায় সেদ্ধ চাল নেওয়া হয়। আমরা যে চাল উদ্ধার করেছি তা আতপ চাল।’ চট্টগ্রামের বাজারে চালগুলো বিক্রির জন্যই অবৈধভাবে আনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রণয় চাকমা স্বীকার করেছেন যে চাল পাচারের সঙ্গে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারের ব্যবসায়ী সাহাব উদ্দিন এবং খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী নুরু সওদাগর জড়িত। তাই আমরা মামলায় এই দুই ব্যবসায়ীকেও আসামি করেছি। চালগুলো কোন প্রকল্পের অধীনে আনা হয়েছে? কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এসব বিষয় পুলিশ খুঁজে বের করবে। আমরা হাতেনাতে ধরেছি। বাকি কাজ পুলিশের।’

হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমরা আদালতে রিমান্ডের আবদেন করেছি। রবিবার রিমান্ড আবেদনের শুনানি হবে। রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হালিশহর থানার উপ পরিদর্শক রাজিব শর্মা বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি সরকারি চাল পাচারের সঙ্গে খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত। তারা ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে চালগুলো পাচার করেন। অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তারাই আত্মীয়স্বজনের নামে নেওয়া ঠিকাদারির লাইসেন্স দিয়ে ব্যবসায়ীদের হাতে চালগুলো তুলে দিচ্ছেন। আসামিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসবে।’

/এপিএইচ/এফএস/ 

আরও পড়ুন: 
তিন হাজার বস্তা সরকারি চাল জব্দ, গ্রেফতার ৫

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী