X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রামে ফল বিপর্যয়ের নেপথ্যে আইসিটি শিক্ষক সংকট!

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
২৪ জুলাই ২০১৭, ১৫:১০আপডেট : ২৪ জুলাই ২০১৭, ১৫:১০

ফলাফল প্রকাশের পর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের শিক্ষার্থীদের উল্লাস ২০১১ সালের আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কম্পিউটার শিক্ষা নামে একটি বিষয় ছিল যা ছিল ঐচ্ছিক। কিন্তু ২০১১ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) নাম দিয়ে বিষয়টি বাধ্যতামূলক করায় বিপাকে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সাবজেক্ট সম্পর্কিত শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বাধ্যতামূলক করায় বিষয়টি এখন পড়াতে হচ্ছে অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের। এতে একদিকে শিক্ষার্থীরা আইসিটি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে নির্বাচনি পরীক্ষাগুলোতে পাসের হার কমে যাচ্ছে। রবিবার প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলেও এর প্রভাব পড়েছে। চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয়ের বিষয়ে কথা বলতে গেলে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. মাহবুব হাসান আইসিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতাকে দোষারোপ করেন।

মাহবুব হাসান বলেন, ‘ফলাফল খারাপ হওয়ার পেছনে আমরা কারণ বিশ্লেষণ করে দেখেছি মানবিকের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ফেল করেছেন। তার প্রভাব সার্বিক ফলাফলে পড়েছে। তাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) না হয় ইংরেজি বিষয়ে ফেল করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমরা যদি বিষয় ভিত্তিক পাস ফেল দেখি তখন দেখা যায় গড়ে বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছেন আইসিটি বিষয়ে। আইসিটিতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা কিছুটা ভালো ফলাফল করলেও ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ রকম খারাপ করেছেন।’

ফলাফল বিশ্লেষণেও বিষয়টি ফুটে উঠেছে। ফলাফলে দেখা যায়, এ বছর চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডে মাত্র ৪৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। যেখানে বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পাসের হার যথাক্রমে ৭৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ৬৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

অন্যদিকে আইসিটিতে তিনটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের শিক্ষার্থীদের পাসের হার কমেছে। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে গত বছর যেখানে ৮৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে সেখানে এই বছর এই বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে ৮৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। অপরদিকে গত বছর মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের ৭৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ আইসিটি বিষয়ে পাস করে। অথচ এইবার এ বিভাগ থেকে ৭১ দশমিক ০৬ শতাংশ আইসিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

আইসিটি বিষয়ে পাঠ্যবই প্রণেতা ড. ফজলুল হাজেরা ডিগ্রি কলেজের আইসিটি বিভাগের প্রধান সায়মা আক্তার বলেন, ‘সরকার যখন ২০১১ সালে আইসিটি বিষয়কে বাধ্যতামূলক করে তখন কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটির শিক্ষক ছিলেন না। এখনও ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই। আর  যেসব প্রতিষ্ঠানে আইসিটির শিক্ষক আছেন তারাও কম্পিউটার সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের না। তাদের কেউ হয়তো জীব বিজ্ঞানের শিক্ষক, না হয় পদার্থের অথবা রসায়নের শিক্ষক। এরা সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ছয় মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিয়ে আইসিটি পড়াচ্ছেন। এ কারণে আইসিটিতে শিক্ষার্থীরা খারাপ করছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারি কোনও কলেজে আইসিটি শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ছয় মাসের কোর্স করা শিক্ষক দিয়ে সাবজেক্টটি পড়ানো হচ্ছে। প্রশ্ন হলো অন্য ব্যাকগ্রাউন্ডের একজন লোক মাত্র ছয় মাসে কম্পিউটার সায়েন্সের কতটুকুই আত্মস্থ করতে পারবেন। যদি নিজে আত্মস্থ করতে না পারেন তবে ওই শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে কী পড়াবেন?’

তিনি আইসিটি বিষয়ে পদ সৃষ্টি করে কম্পিউটার সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের ওই পদে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সরকারি কোনও স্কুল কলেজে আইসিটির কোনও নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে হয় বিজ্ঞানের শিক্ষক না হয় ব্যবসায় প্রশাসনের অথবা মানবিকের শিক্ষকরা আইসিটি বিষয় পড়াচ্ছেন। নগরীর ৫টি কলেজ ছাড়া অন্য কলেজগুলোতে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য কোনও পদই সৃষ্টি করা হয়নি। গত ৫/৬ মাস আগে সারা দেশে আইসিটি বিষয়ের জন্য ১৩৭টি পদ সৃষ্টি করা হয়। তখন নগরীর চট্টগ্রাম কলেজ, হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, সরকারি সিটি কলেজ, কমার্স কলেজ ও সরকারি মহিলা কলেজে-এ একটি করে পদ সৃষ্টি করা হয়। তবে এখনও কলেজগুলোতে কোনও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বর্তমানে ওই কলেজের আইসিটি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত এমদাদ হোসেন বলেন, ‘সরকার পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করে দেয়। তাই আইসিটি বিষয়ের কোনও শিক্ষক না থাকায় এ বিষয়ের ক্লাস নিচ্ছেন অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা। যাদের আইসিটি বিষয়ে কোনও জ্ঞান নেই। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে বাংলা এমনকি দর্শনের শিক্ষকরাও আইসিটি বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। ফলে এ বিষয়ে কোনও কিছুই শিখছে না শিক্ষার্থীরা। কিছু তত্ত্ব বা থিওরি মুখস্থ করে পাস করলেও বাস্তবজীবনে এর কোনও প্রয়োগও শিখছে না তারা।

তিনি বলেন, ‘সরকারকে অচিরেই এ বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় যে উদ্দেশ্য নিয়ে এর যাত্রা শুরু, তা কার্যকর করা সম্ভব নয়।’

একই কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মুনতাসির মোরশেদ বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি পরীক্ষা উঠে যাওয়ায় এখন একাদশ শ্রেণিতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বেশি হারে ভর্তির সুযোগ পান। কারণ মাধ্যমিকে খাতা দেখার সময় মাদ্রাসার শিক্ষকরা বেশি বেশি নম্বর দেন। এতে করে ফলাফলে তারা এগিয়ে থাকে। পরবর্তীতে ওই ফলাফল কাজে লাগিয়ে তারা সরকারি কলেজগুলোতে বেশি ভর্তির সুযোগ পায়। মানবিকে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ মাদ্রাসার হওয়ায় তারা আইসিটিতে খারাপ করছে। ইংরেজিতেও দুর্বল হওয়ায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এই বিষয়েও খারাপ ফলাফল করছে।’

তিনি বলেন, ‘আইসিটি সায়েন্স সম্পর্কিত বিষয়। মানবিকের শিক্ষার্থীরা এ কারণে বেশি খারাপ করে। আর অন্য একটা ডিসিপ্লিন থেকে আসার কারণে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আরও বেশি খারাপ করে।’

এবার চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। এ বছর এই শিক্ষা বোর্ডে পাস করেছে ৬১ দশমিক ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৩৯১ জন।

/বিএল/ 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে