X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ঘরের মদ্যি হাঁটু পানি, থাকপো কই?’

তৌহিদ জামান, যশোর
২৬ জুলাই ২০১৭, ১৩:২৪আপডেট : ২৬ জুলাই ২০১৭, ১৩:৩১

অভয়নগরে পানিবন্দিরা আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু এলাকায় গত চারদিনের টানা বৃষ্টিতে যশোরের তিনটি উপজেলার ১১৫টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মাছের ঘের, ধানের ক্ষেত আর বীজতলা। পানিবন্দ লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার ধারে। টানা বর্ষণে তিনটি উপজেলার কয়েক হাজার মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে কয়েকশ’ কোটি টাকার।   

মণিরামপুরে পানিবন্দি ৪৪ গ্রামের মানুষ: টানা বর্ষণে মণিরামপুরের ৯টি ইউনিয়ন এবং পৌরসভার কামালপুর ও মোহনপুর এলাকাসহ ৪৪টি গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার পবিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৪৬৩টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। ভেসেছে ফসলি জমি। অনেকে আশ্রয় নিচ্ছেন রাস্তাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাছাড়া পানি ঢুকে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে প্রায় অর্ধশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

নাগোরঘোপ স্কুলে আশ্রয় নেওয়া শতবর্ষী বৃদ্ধ ওয়াজেদ মোড়ল বলেন,‘ঘরের মদ্যি হাঁটু পানি, থাকপো কই। তাই বাড়ি ছাড়ছি।’একই সুরে কথা বললেন ওই এলাকার রফিকুল ও সোহরাব আলীর। 

পানিতে তলিয়ে গেলে ঘরবাড়ি
শ্যামকুড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনি বলেন,‘হরিহর নদীর পলি অপসারণ না করায় পানি নদীর দেড় ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের প্রায় ৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে ইতিমধ্যে ২০০ পরিবার নাগোরঘোপ, আমিনপুর, চিনাটোলা স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে।’
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) লিংকন বিশ্বাস, সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল কবীর ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইয়ারুল হক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টানা বর্ষণে মণিরামপুরের শ্যামকুড়, খানপুর, দূর্বাডাঙ্গা, কুলটিয়া, চালুয়াহাটি, হরিদাসকাটি, মনোহরপুর, মশ্মিমনগর এবং হরিহরনগর ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া পৌরসভার কামালপুর ও মোহনপুর কারিগর পাড়ার ৩৩৫ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইয়ারুল হক বলেন,‘স্থানীয় চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে এই পর্যন্ত মশ্মিমনগরে দুটি কাঁচা ঘর ভেঙে পড়াসহ ৯টি ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া প্রায় ৩০০ হেক্টর আবাদী জমি পানিতে তলিয়ে গিয়ে বীজতলাসহ ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে।’

ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে দ্রুতই জেলা প্রশাসকের দফতরে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি।

‘ঘরের মদ্যি হাঁটু পানি, থাকপো কই?’
টানা বর্ষণে মুক্তেশ্বরী ও টেকা নদীর পানির উজান ঢলে উপজেলার বিল কেদারিয়াসহ আশপাশের ৪৬৩টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় ১৫ কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছেন মৎস্য চাষিরা।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল কবীর বলেন, ‘আগামীতে ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। সেকারণে দ্রুত মুক্তেশ্বরী নদীর ১৫ কি.মি. এলাকার কচুরিপানা ও পাটা অপসারণসহ খাল দখলমুক্ত না হলে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে।’
কেশবপুরে প্লাবিত ৪০ গ্রাম: টানা বৃষ্টিতেকেশবপুরের জলাবদ্ধ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত ৪ দিনের অতিবৃষ্টি এবং হরিহর, বুড়িভদ্রা ও কপোতাক্ষ নদের পানি উপচে পড়ে জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এসব এলাকা। এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে কেশবপুর পৌর শহরের ১০টি ওয়ার্ডসহ উপজেলার প্রায় ৪০টি গ্রাম। ভেসে গেছে ২ হাজার ৩১৮টি মাছের ঘের এবং তিন হাজার ২৫০টি পুকুরের মাছ। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩২ কোটি টাকা। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার। 
যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের দুই পাশে মধ্যকুল ও হাবাসপোল এলাকার প্রায় ৪০০ পরিবার, আলতাপোলে ৭৫টি ও বাজিতপুরে ৩০টি পরিবার টং ঘর বেঁধে আশ্রয় নিয়েছে। 
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরের কেশবপুর ডিগ্রি কলেজ, পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পাইলট বালিকা বিদ্যালয়, মধুশিক্ষা নিকেতন, মধ্যকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বালিয়াডাঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্রসহ ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

‘ঘরের মদ্যি হাঁটু পানি, থাকপো কই?’
কেশবপুর পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদ খনন না করা এবং অপরিকল্পিতভাবে মাছের ঘেরে করায় কয়েক বছর ধরে এখানে বন্যা হলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ তা দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে। 
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আলমগীর হোসেন জানান, কেশবপুর উপজেলায় ২ হাজার ৩১৮টি মাছের ঘের ও ৩ হাজার ২৫০টি পুকুর ভেসে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

কেশবপুর পৌরমেয়র রফিকুল ইসলাম মোড়ল জানান, বন্যার ফলে পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের ৪ হাজার ৪০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। 
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম সাইফুর রহমান বলেন, কেশবপুরের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আশ্রয়হীনদের জন্য পৌর এলাকায় ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক ইউপি চেয়ারম্যানকে সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আশ্রয়কেন্দ্র করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছেন লোকজন
তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ মে.টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এগুলো বণ্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
অভয়নগরে ভেসে গেছে ৬০ কোটি টাকার মাছ: টানা বর্ষণে অভয়নগরে বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট, পুকুর মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ কোটি টাকা।  
অভয়নগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার তিনটি গ্রাম জলাবদ্ধ। ডুবে যওয়া এলাকার মধ্যে রয়েছে, প্রেমবাগ ইউনিয়নের ৫টি, সুন্দলী ইউনিয়নের ৯টিসহ পায়রা ইউনিয়নের ৩১টি গ্রাম। পানিবন্দি প্রায় ২ হাজার ৭৫০ পরিবার। পানিতে তলিয়ে গেছে আউশ- আমন ধান, সবজি ক্ষেত এবং আমন বীজতলা। 
উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুর রউফ জানান, প্রায় সাড়ে চার হাজার মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ কোটি টাকা। 

‘ঘরের মদ্যি হাঁটু পানি, থাকপো কই?’

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্ববায়ক রণজিত বাওয়ালী বলেন, ‘জল কেবল উঠতে শুরু করেছে। যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তাতে গত বছরের মতো ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। সরকার জোয়ারাধার না করে নদী খনন করে অর্থ অপচয় করছে। ফলে জলাবদ্ধতা দূর হচ্ছে না।

এ বিষয়ে অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনদীপ ঘরাই বলেন, উপজেলার প্রায় ২ হাজার ৭৫০ পরিবার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত এবং ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছেন। জলাবদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বুধবার থেকে একটি হটলাইন (০১৭৭৮০ ৩৪৫৪৩৪) চালু করা হয়েছে। যা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে।
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে নিড অ্যাসেসমেন্ট করেছি। আমডাঙ্গা খাল ও ডুমুরতলা এলাকায় নদীর কচুরিপানা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

/এসটি/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে শোকজ
কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে শোকজ
বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া ঋণ মিলবে না
বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া ঋণ মিলবে না
ওমরা পালনে সৌদি গেলেন পাটমন্ত্রী
ওমরা পালনে সৌদি গেলেন পাটমন্ত্রী
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা