বুড়ো হাড়ের ভেল্কি দেখালেন নেত্রকোনার মদন উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য। ৬৬ বছর বয়সে একটানা ৪৩ ঘণ্টা সাঁতরে ১শ' ৪৬ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়েছেন এ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। শুক্রবার (৪ আগস্ট) বিকাল ৬টা ৫০ মিনিটে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার কংস নদীর সরচাপুর সেতু থেকে সাঁতার শুরু করেন ক্ষিতিন্দ্র। রবিবার (৬ আগস্ট) দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে নেত্রকোনার মদন উপজেলার মগড়া সেতুতে গিয়ে সাঁতার শেষ করেন। সাঁতারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টহল নৌকায় ক্ষিতিন্দ্রের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি, স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক ও গণমাধ্যমকর্মীরা। রাস্তার দু'পাশে ভীড় জমিয়ে হর্ষধ্বনি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন নদীপাড়ের মানুষরা।
বার্ধক্যে এসেও এ ধরণের চমক জাগানিয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'গিনেজ বুকের রেকর্ড লিস্টে নাম তোলার স্বপ্ন থেকে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনেকবার সাঁতার কেটেছি জীবনে। রেকর্ডও করেছি। কিন্তু ৬৫ বছর বয়স পার করার পরে কেউ অবিরাম এতোক্ষণ সাঁতরেছে, এমন কোন তথ্য পাইনি আগে।’ এ ঘটনাকে একটি রেকর্ড উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার জীবনের শেষ সাঁতার।’
ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য ১৯৫২ সালের ২৩ মে নেত্রকোনার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার না ক্ষিতিশ চন্দ্র বৈশ্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১১ নম্বর সেক্টর থেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে ১৯৭৬ সালে মাস্টার্স করেন এ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। পরবর্তীতে সরকারি চাকরিতে যোগদান করে ৬ জুন ২০১২ সালে অবসরে যান দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাঁতারু ক্ষিতিন্দ্র।
এই সাঁতারের আয়োজনটি যৌথভাবে করা হয় ফুলপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও মদন উপজেলা নাগরিক কমিটির উদ্যোগে। শুক্রবার (৪ আগস্ট) বিকালে ময়মনসিংহ-২ আসনের সংসদ সদস্য শরীফ আহমেদ এই সাঁতার অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। রবিবার (৬ আগস্ট) দুপুরে সাঁতার শেষ হওয়ার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্রকে অভিনন্দন জানান মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়ালিউল হাসান ও উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম আকন্দ। এসময় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে তার কোনও শারীরিক ক্ষতি হয়েছে কিনা তা পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা তাকে শতভাগ সুস্থ ঘোষণা করেন।
সাঁতারের প্রতি আগ্রহের ব্যাপারে ক্ষিতিন্দ্র জানান, ১৯৭০ সালে সিলেটের ধুপাদীঘি পুকুরে অরুণ কুমার নন্দীর বিরামহীন ৩০ ঘণ্টার সাঁতার প্রদর্শনী দেখে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। পরে একই বছর মদনের জাহাঙ্গীরপুর উন্নয়ন কেন্দ্রের পুকুরে তিনি ১৫ ঘণ্টার সাঁতার প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে এলাকায় আলোচিত হন। এটিই তার প্রথম সাঁতার।
এ ব্যাপারে তিনি আরও জানান, পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশন পুকুরে ৩৪ ঘণ্টা, সুনামগঞ্জের সরকারি হাইস্কুলের পুকুরে ৪৩ ঘণ্টা, ১৯৭৩ সালে ছাতক হাইস্কুলের পুকুরে ৬০ ঘণ্টা, সিলেটের এমসি কলেজের পুকুরে ৮২ ঘণ্টা এবং ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পুকুরে ৯৩ ঘণ্টা ১১ মিনিট বিরামহীন সাঁতার প্রদর্শন করে জাতীয় রেকর্ড করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি জগন্নাথ হলের পুকুরে ১শ ৮ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের পুকুর পাড়ে তার নামে স্মারক ফলক নির্মাণ করে।
১৯৮০ সালে মাত্র ১২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটে মুর্শিদাবাদের ভাগিরথী নদীর জঙ্গীপুর ঘাট থেকে গোদাবরী ঘাট পর্যন্ত ৭৪ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দেন। এ ঘটনাকে জীবনের অন্যতম রোমাঞ্চকর স্মৃতি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এই সাঁতারের আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক মদন পৌরসভার সাবেক মেয়র দেওয়ান মোদাচ্ছের হোসেন শফিক জানান, ক্ষিতিন্দ্রের দীর্ঘ দিনের ইচ্ছা ছিল এমন একটি সাঁতারের মাধ্যমে তিনি আর্ন্তজাতিক গিনেজ বুকে স্থান পাবেন। এ কারণেই এ সাঁতারের আয়োজন করা হয়।
/এএইচ//এমএ/