বাংলাদেশে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে নতুন করে সেদেশের সেনা মোতায়েন হওয়ায় এ অবস্থা দেখা দিয়েছে। এ কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় বাংলাদেশ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন করে সতর্ক নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহ ধরে সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি’র পাশাপাশি অতিরিক্ত সেনা সদস্য মোতায়েন করেছে মিয়ানমার সরকার। ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেনা মোতায়েন করায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এতে করে আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভয়-ভীতি দেখা দিয়েছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গত এক সপ্তাহে অন্তত দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে রাখাইন রাজ্যের একাধিক সূত্র।
রাখাইন রাজ্যের খোয়ারবিলের মুজিব উল্লাহ, নাইচাপ্রোর আনোয়ার ইসলাম, বুচিডংয়ের মিনা আরা বেগম ও রাশিঢং গোদামপাড়া এলাকার মৌলনা মুফিজ মিয়াসহ অনেকেই মুঠোফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, হঠাৎ করে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক সেনা মোতায়েন করেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ঘরে তল্লাশি করে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুরুষদের। এসময় নির্যাতন করে অনেককে ছেড়ে দেওয়া হলেও অধিকাংশের খোঁজ নেই। বর্তমানে তারা বাড়িঘর থেকে বের হতে পারছেন না।
তারা আরও জানান, মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) সকালে মিয়ানমারের মংডু উপজেলার রাশিঢং ইউনিয়নের গোদাম পাড়া গ্রাম থেকে চাষাবাদের কাজ করার সময় আট জনকে ধরে নিয়ে যায় সেদেশের সেনারা। এর মধ্যে ছয় জনকে ফেরত দিলেও দুই জন এখনও নিখোঁজ রয়েছে। আর যে ছয়জনকে ফেরত পাঠিয়েছে তাদের শরীরে নানা নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। এভাবে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১১ গ্রাম থেকে দুই শতাধিক লোককে ধরে নিয়ে গেছে সেদেশের সেনাবাহিনী।
কক্সবাজারের কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ ইউনুচ আরমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে খবর নিয়ে জেনেছি সীমান্তে প্রায় পাঁচ শতাধিক সেনা সদস্য মোতায়েন করেছে মিয়ানমার সরকার। তাদের প্রত্যেকের হাতে ভারী অস্ত্র রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের উগ্রপন্থী সংগঠন ‘আল-ইয়াকিন’ ও ‘আরসা’র বিরুদ্ধে অভিযানের নামে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তবে আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে আরকানে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।’
উখিয়ার বালুখালীর নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি শামসুল আলম বলেন, ‘নতুন করে উত্তেজনা তৈরির পর এ পর্যন্ত নতুন করে কোনও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করেনি। তবে যে কোনও সময় মিয়ানমারে বড় ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে। যদি এমনটিই ঘটে তাহলে দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।’
কক্সবাজারের উখিয়ার রহমতের বিল ও ধামনখালী সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা এবং পালংখালী ইউপি’র ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোজাফ্ফর আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এপর্যন্ত কোনও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেনি। মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের টহল দিতে দেখেছি। একইভাবে রাখাইন রাজ্যে বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েনের কথা শুনেছি। মিয়ানমারে এভাবে সেনা মোতায়েন করতে থাকলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার আশঙ্কা রয়েছে।’
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে সেদেশের সরকারকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী কোনও দেশের সীমান্তে সেনা মোতায়েন করতে হলে পার্শ্ববর্তী দেশকে অবহিত করেই করতে হয়। এজন্য আমরা আমাদের সীমান্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সতর্ক রয়েছি। কোনোভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।’
টেকনাফে ২নং বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বলেছেন 'সীমান্তের ওপারে রাখাইনে সেনা মোতায়েন খবরে আমরা বিচলিত নই। কারণ সেটি মিয়ানমার সরকারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তারপরও সীমান্তের কাছাকাছি এভাবে সেনা সমাবেশ বাড়ানোর ঘটনায় আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছি। বাংলাদেশের মিয়ানমার সীমান্তের স্থল ও জলপথ সমুহে বিজিবিকে সতর্কবস্থায় রাখা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পর একইভাবে আরকানে সেনা মোতায়েন করেছিল মিয়ানমার সরকার। সে সময় রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হয় অমানবিক দমন-পীড়ন ও নির্যাতন। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের অন্তত শতাধিক গ্রামে আগুন দেয়। হত্যা করে হাজারের বেশি নিরীহ ব্যক্তিকে। নিখোঁজ হয় বহু রোহিঙ্গা। নারী ও শিশুদের ধর্ষণ করা হয়। বাড়িঘর হারিয়ে উদ্বাস্তু হয় লক্ষাধিক মানুষ।
সে সময়ে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রাখাইন রাজ্যে সেনা নিপীড়ন কিছুটা কমে আসে। তবে এখন ফের সেনা মোতায়েনে নতুন করে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সীমান্তে বসবাসরত অনেকই।
/এফএস/