X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘নদীর এপারে ত্রাণ নাই, সব যায় চরে’

রায়হানুল ইসলাম আকন্দ, ইসলামপুর থেকে ফিরে
২৬ আগস্ট ২০১৭, ১৪:২১আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০১৭, ১৪:২১

জামালপুরে ত্রাণের আশায় বন্যাদুর্গতরা (ছবি: গাজীপুর প্রতিনিধি) ‘নদীর ঘাটে সবাই শুধু নৌকায় ত্রাণ তুলে চরে নিয়ে যায়। অথচ গত চারদিন যাবত চুলায় আগুন ধরাতে পারি না স্যাঁত স্যাঁতে মাটির কারণে। কাজ নাই, মজুরিও নাই। জমানো টাকা নাই তাই খাবারও নাই।’ জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলী গ্রামের হালিমা বেগম (৪০) এই কথা বলেন। নদীর তীর থেকে দূরে বসবাসের কারণে ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন ইসলামপুরের বেলগাছা ও চিনাডুলী ইউনিয়নের যমুনা নদী পাড়ের দুর্গত এলাকার মানুষজন।

গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা থেকে ব্যবসায়ীরা শুকনো খাবারের এক হাজার প্যাকেট নিয়ে শুক্রবার দুপুরে ইসলামপুরে যমুনা নদীর পাড়ে যান। নৌকায় ত্রাণের মালামাল ওঠানোর সময় স্থানীয় দুর্গত মানুষ গাট্টুলী এলাকার যমুনা নদীর ঘাটে ভিড় করেন। এসময় চিনাডুলী ইউনিয়নের গাট্টুলী গ্রামের ভোলানাথের ছেলে ভিক্ষু বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনে দিয়ে প্রতিদিন ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে লোকজন। গত চারদিন ধরে আমাদের ঘর থেকে পানি নেমে গেছে। বন্যার কারণে সাত থেকে ১০ দিন পর্যন্ত পানিবন্দি ছিলাম আমরা। তখন কেউ ত্রাণ দিতে আসেনি। পানি কমে গেছে এখন সবাই ত্রাণ নিয়ে নদীর ওপারে যাচ্ছে। একবার সামান্য চিড়া পেয়েছি, আর কোনও ত্রাণ আমাদের কেউ দিচ্ছে না।’ জামালপুরে ত্রাণের আশায় বন্যাদুর্গতরা (ছবি: গাজীপুর প্রতিনিধি)

একই গ্রামের সালেহা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী ও ছেলে নেই। একটি মাত্র কন্যা। গত ১৫ দিন যাবত চুলায় রান্না হয় না। একদিন ঢাকা থেকে কয়েকজন লোক সামান্য চিড়া দিয়ে গেছে। সেই চিড়া খেয়েই আছি আমরা।’

বেলগাছা গ্রামের মিন্টুর স্ত্রী সুলতানা আক্তার বলেন, ‘ঘরের মেঝেতে পানি কমছে তিন দিন আগে থেকে। চুলা ও ঘরের মেঝে এখনও স্যাঁত স্যাঁতে ভেজা। শুকনো খাবার বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়। সম্মানের ভয়ে কারও কাছে মুখ খুলে সাহায্য চাইতেও পারি না। অথচ আমাদের সামনে দিয়ে ত্রাণ নিয়ে যায় যমুনার চর এলাকায়।’ জামালপুরে ত্রাণের আশায় বন্যাদুর্গতরা (ছবি: গাজীপুর প্রতিনিধি)

একই গ্রামের আব্দুস ছালামের কন্যা আছমা আক্তার বলেন, ‘অন্যের জমিতে বসবাস করি। জমির ভাড়া দেই। ত্রাণ দিতে এলে অনেকেই মনে করে নিজের জমিতে থাকি, ভালোভাবেই আছি। তারা কেউ খোঁজও নেয় না। সরাসরি যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে চরে চলে যায়।’

চিনাডুলী গ্রামের মমিনের ছেলে মাসুদ মিয়া বলেন, ‘আগে ছিলাম চৌহাদচর গ্রামে। বছরে সাত হাজার টাকা দিয়ে জমি ভাড়া নিয়ে চিনাডুলীতে বসবাস করি। প্রতি বছর বন্যায় ঘরে পানি ওঠে, রান্নার চুলা ডোবে। সামান্য ত্রাণ আসে। কিন্তু স্থায়ীভাবে সমাধানের কোনও উপায় কেউ করে না।’ জামালপুরে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ (ছবি: গাজীপুর প্রতিনিধি)

মইন্নারচর এলাকার আলম মাঝি বলেন, ‘আমার ঘরের পানি গত দু’দিন আগে কমেছে। বন্যার পানিতে না খেয়ে তার দুটি ছাগল মারা গেছে। পাটগুলো সব পঁচে গেছে। পনি কমে গেলেও ভেজা মাটির কারণে চুলা জ্বালানো যাচ্ছে না। পানি কমার পর মাত্র এক লিটার পানি, ২টি খাবার স্যালাইন ও আধা পোয়া গুড় পেয়েছি।’

একই এলাকার সুরুজ্জামান বলেন, ‘ঘরের চালে উঠে থাকতে হয়েছে আটদিন। আমার ভাই বাড়ি ছেড়ে স্থানীয় বিএস স্কুলে সপরিবারে আটদিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছে। এখন খাবার কিছু নেই।’

চরকুলকান্দি গ্রামে ত্রাণ বিতরণের সময় দেখা গেছে কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর করে পানিতে নেমে এসেছেন অশীতিপর খলিলুর রহমান। তাদের সঙ্গে সত্তরোর্ধ আব্দুস ছাত্তার, কসের মন্ডল বুক সমান পানি ভেঙে ত্রাণ নিতে আসেন।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা চৌরাস্তা ব্যবসায়ীদের পক্ষে ত্রাণ দিতে যাওয়া কাকলী ফার্ণিচারের চেয়ারম্যান এস এম সোহেল রানা বলেন, ‘বন্যা উপদ্রুত এলাকায় পানি নেমে যেতে শুরু করেছে। তবে এসময়েই তাদের পাশে আমাদের দাঁড়ানো উচিত।’ তিনি জানান, চার কেজি চিড়া ও এক কেজি চিনির একটি করে মোট এক হাজার প্যাকেট তৈরি করে বেলগাছা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরিবারগুলোর মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। জামালপুরে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ (ছবি: গাজীপুর প্রতিনিধি)

এসব বিষয়ে বেলগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক বলেন, গত চারদিন ধরে প্রতিদিন তিন চারটি করে টিম আসছে ত্রাণ দেওয়ার জন্য। তার ইউনিয়নের প্রত্যেকটি বন্যা দুর্গত পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ১০ কেজি করে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। স্থানীয় সাংসদসহ বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিরা ত্রাণ বিতরণ করছেন। তারপরও ত্রাণ গ্রহীতারা ত্রাণ পাচ্ছে না বলে ভুল তথ্য দিচ্ছে।

জামালপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বন্যায় ৭ উপজেলার ৮টি পৌরসভা, ৬২টি ইউনিয়নের ৬৭৪ গ্রামের ১ হাজার ২৮৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, সরিষাবাড়ী, জামালপুর সদর,  বকশীগঞ্জ, মেলান্দহ ও মাদারগঞ্জে সাড়ে দশ লাখ মানুষ এখনও দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। পানি নেমে গেলেও বন্যা কবলিত এলাকার রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি, ঘরের আসবাবপত্র, আবাদী জমি, মাছ চাষের পুকুর সবখানেই ক্ষতির চিহ্ন রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন- ত্রাণে কাটছে না খাদ্য সংকট

/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কুড়িয়ে পাওয়া সাড়ে চার লাখ টাকা ফিরিয়ে দিলেন ইজিবাইকচালক
কুড়িয়ে পাওয়া সাড়ে চার লাখ টাকা ফিরিয়ে দিলেন ইজিবাইকচালক
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং দ্বৈরথ
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং দ্বৈরথ
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি