‘আল্লার বায়দি কাল্লা দিয়া বইয়া রইছি (আল্লাহর মুখের দিকে চেয়ে আছি)। ঝিপুত কান্দে নয়া কাপড়ের লাইগা, টেকা নাই, পয়সা নাই ঝিপুতরে কাপড় দিমু কিদ্দা?’ কথাগুলো বলছিলেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের সুফিয়া খাতুন। পরপর দুইবার অকাল বন্যায় নিঃস্ব সুফিয়ার মনে নেই ঈদের আনন্দ। পাশে দাঁড়ানো ছিলেন তছলিমা আক্তার। তিনিও জানান, গত দুই বছর যাবৎ তারা ঘরে একমুঠো ধান তুলতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘অভাবের বছর। ফুরুতায় কান্দে নুতন কাপড়ের লাইগা। নতুন কাপড় তো দূরের কথা পুরান কাপড় দেয়ারও সামর্থ্য নাই।’
ঈদের কথা জানতে চাইলে হোসেনপুর গ্রামের আব্দুল হালিম বলেন, ‘মাইগা মুইগা পোলাপানরে কোরবানির গোশত খাওয়ানি লাগবো। বৈশাখী ফসল ঘরে তুলে হাওরবাসী দুই প্রস্ত কাপড় কিনেন সারা বছর পরার জন্য। এ বছর কারো গায়ে নতুন লুঙ্গি, শার্ট বা শাড়ি ওঠেনি। ছিন্ন কাপড় গায় দিয়ে দিন কাটছে হাওরবাসীর।’
চিকসা গ্রামের নুরুনেচ্ছা বলেন, ‘কোরবানির গোশত ফুরুতারে খাওয়ানোর সামর্থ্য কারও নেই। ঈদের দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে কোরবানির গোশত সংগ্রহ করতে পারলেই ফুরুতার মুখে গোস্ত ভাত পড়বে।’
তফুয়া বেগম জানান, পোলাপানের মুখের দিকে চেয়ে ঈদের দিন ভোরে শহরে চলে আসবেন কোরবানির গোশতের জন্য। সারাদিন গোশত সংগ্রহ করে বেলা শেষে রাতে পোলাপানের জন্য গোস্ত ভাত রান্না করবেন। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই তার।
নাসু বেগম বলেন, ফসল নষ্ট না হলে তাদের গ্রামের ৫/৬ জন বড় কৃষক কোরবানি দিতেন। এ বছর ফসল ডুবে যাওয়ায় কেউ কোরবানি দিচ্ছেন না। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যেগে ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসীর কাছে ঈদ কোনও আনন্দের বার্তা বয়ে আনেনি। ঘরে ঘরে চলছে হাহাকার। মাছ ধরা আর কৃষিকাজ ছাড়া বিকল্প কোনও কর্মসংস্থান না থাকায় তারা বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। আয় রোজগার না থাকায় সংসারে দেখা দিয়েছে চরম দরিদ্রতা। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে বন্যা, শিলাবৃষ্টি ও কাল বৈশাখী ঝড়ে সর্বশান্ত হাওরবাসী। আগামী বোরো ফসল ঘরে না ওঠা পর্যন্ত মানুষের হাহাকার যাবে না। চৈত্রের অকাল বন্যায় হারিয়েছেন বোরো ধান আর শ্রাবণের মৌসুমি বন্যায় হারিয়েছেন আমন। এখন তাদের জন্য আর কোনও ফসল নেই।
জয়নগর গ্রামের জোসনা বেগম বলেন, দুর্গত মানুষ বসতবাড়ি, গাছপালা বিক্রি করে কিছুদিন সংসার চালিয়েছেন। এখন আর বিক্রির কোনও কিছু নেই, আর কেনার মানুষও নেই।
দোয়ারবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিস আলী বীর প্রতীক বলেন, বারবার প্রকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসীর সামনে এখন কোনও সুখ স্বপ্ন নেই। হতাশা আর হাহাকারের মধ্যে তারা বেঁচে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহযোগিতা করা হচ্ছে কিন্তু তাও সীমিত।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকার ঈদ উপলক্ষে দুর্গতদের মধ্যে জিআর চাল বিতরণ করেছে। এছাড়া ১ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ ভিজিএফ কর্মসূচির মাধ্যমে নিয়মিত খাদ্য সহযোগিতা পাচ্ছেন। প্রশাসন আন্তরিকভাবে দুর্গতদের পাশে রয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।