চাঁপাইনবাবগঞ্জে চালের বাজারে আবারও অস্থিরতা দেখে গেছে। গত এক সপ্তাহে সেখানে চাল কেজি প্রতি ৮-১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ভারত চাল রফতানি করবে না গুজব ও বন্যায় ধানের ব্যাপক ক্ষতির কারণে হাট-বাজারে ধানের আমদানি কমে গেছে বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ধান-চালের অবৈধ মজুদ করে বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠেছে ব্যবসায়ী ও চালকল মিলারদের বিরুদ্ধে।
এদিকে খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের অভিযোগ, মিলারদের সিন্ডিকেটের কারণেই চালের এমন মূল্যবৃদ্ধি। যদিও মিল মালিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, ধানের সংকটই দাম বাড়ার মূল কারণ। অপরদিকে, সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে জুলাই থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮০ হাজার ৯৬৩ মেট্রিক টন চাল আমদানি হলেও বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। আর প্রশাসন বলছে, চাল মজুদকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন পেলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
যদিও গত বৃহস্পতিবার জেলায় ধান-চালের মজুদ কত? এ বিষয়ে জেলা বাজার মনিটরিং কমিটির সদস্যরা সরেজমিন প্রতিবেদন দিলেও, জেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনও ধরনের কার্যক্রম হাতে নেননি। উল্টো অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের সঙ্গে র্দীর্ঘদিন ধরে অটো মিল মালিকদের সখ্যতা (জাতীয় ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রশাসনিক কর্মসূচিতে সুযোগ-সুবিধা নেওয়া) থাকায় এখন পর্যন্ত তেমন কোনও ধরনের ব্যবস্থায় নেওয়া হয়নি। এমনকি কী পরিমাণ ধান-চাল মজুদ আছে সে বিষয়েও প্রশাসন কিছুই জানাতে পারেননি।
আরও জানা গেছে, জেলা বাজার মনিটরিং কমিটি ও জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরা তাদের তালিকাভুক্ত মিলগুলোর মধ্যে মাত্র ১২টি মিল পরিদর্শন করলেও, জেলায় কতগুলো তালিকাভুক্ত ও তালিকার বাইরে চাল-কল মিল রয়েছে এবং তাদের অবস্থান কি? এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এসব বিষয়ে কোনও তথ্য জানাতে পারেনি স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টরা।
জেলা মার্কেটিং অফিসার মো. নুরুল ইসলাম জানান, ঈদের এক সপ্তাহ পর থেকে জেলার বাজারগুলোতে আবার চালের দাম বাড়তে থাকে। মিনিকেট (চিকন) চাল ৫২-৫৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫৮-৬০ টাকা, মাঝারি বিআর-২৮ চাল ৪৮-৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৫৪-৫৬ টাকা এবং মোটা গুটি স্বর্ণা পারিজা ৪৫-৪৭ টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৫২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। জেলার চালের বাজার মনিটরিংয়ের জন্য জেলা প্রশাসকের জরুরি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসার জেলার তালিকাভুক্ত বিভিন্ন অটোরাইস মিল ও গোডাউনের চালের স্টক পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তবে, অবৈধ মজুদের তথ্য পাননি বলে মার্কেটিং অফিসার জানান।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসার মো. রিয়াজুর রহমান রাজ জানান, জেলায় চলতি ইরি-বোরো চাল কেনার জন্য তালিকাভুক্ত ১৯২ জন চাল মিল মালিকের সঙ্গে চুক্তি হয়। তারা ১৬ হাজার মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করার কথা থাকলেও মাত্র ২৯ জন চাল মিল মালিক ১ হাজার ৪০৬ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করে। চাল সরবরাহ দিতে ব্যর্থ ১৬৩ জন মিল মালিকের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অংশ হিসেবে আগামী দুই বছর তারা সরকারের কাছে আর চাল বিক্রি করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, চালের বাজার মনিটরিং হিসেবে ১ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন মিল মালিকরা ২ হাজার মেট্রিক টন চাল মজুদজাত করতে পারবে মাত্র এক মাস। তবে, বিভিন্ন মিল পরিদর্শনের সময় অতিরিক্ত মজুদের তথ্য মেলেনি।
তিনি জানান, জেলায় অটোরাইস মিলের উৎপাদনকৃত চালের সিংগভাগই চলে যায় ঢাকা, চট্রগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে, চালের বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) থেকে জেলা সদরের পৌর এলাকায় ১৩ জন ডিলারের মধ্যে ৬ জন ডিলার প্রতি সপ্তাহে শনিবার বাদে ৬ দিন ৬ মেট্রিক টন করে খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুরু করেছে।
তহাবাজারের খুচরা ব্যবসায়ী কালু, সেলিমসহ আরো কয়েকজন জানান, বড় বড় ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা ধান-চালের অবৈধ মজুদ করে তারাই সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
সোনামসজিদ স্থলবন্দরের শুল্ক স্টেশনের সহকারী কমিশনার সাইদুল ইসলাম জানান, সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে গত জুলাই থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮০ হাজার ৯৬৩ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে।
আমদানিকারক মেরাজুল ইসলাম জানান, ভারতে চালের বাজার চড়া হওয়ার কারণে আগে এলসি করা চাল রফতানিকারকরা এখন চাল পাঠাতে বিলম্বিত করছে। এমনকি রফতানিকারকরা, প্রতি টনের এলসিতে আরও ১০০ ডলার বাড়িয়ে ৫০০ ডলার করার পায়তারা করছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার ও অটোরাইস মিল মালিক গ্রুপের সভাপতি এরফান আলী বলেন, ‘ঈদের আগে হাট-বাজারে ধানের আমদানি যথেষ্ট ছিল, কিন্তু ঈদের পরে বাজারে ধানের আমদানি একেবারে কমে গেছে। আর ঈদের আগে মোটা ধান ১ হাজার ১৫০ টাকা মন দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে ১ হাজার ৩৭৫- ১ হাজার ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন আমন ধান উঠতে আরও ২ মাস দেরি এবং পত্র পত্রিকায় চালের দর আরও বাড়বে এসব বিভ্রান্তমূলক সংবাদ প্রচারের জন্য কৃষকরা পরিমাণমত ধান বিক্রি করায় বাজারের ধানের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। আর এলসি করা ভারতীয় চাল স্থলবন্দরে পুরোপুরি এসে পৌঁছালেই বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা (ভারপ্রাপ্ত) প্রশাসক মো. এরশাদ হোসেন খান জানান, ‘চালের বাজার ও মজুদকারীদের ব্যাপারে প্রশাসন খুবই সতর্ক রয়েছে। ইতোমধ্যে বাজার মনিটরিং কমিটির জরুরি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলার বিভিন্ন অটোরাইস মিল ও গোডাউনের চালের স্টক পরিদর্শন শেষ করেছেন কমিটির সংশ্লিষ্টরা। প্রতিবেদন পেলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।