X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধান হারানো হাওরের কৃষকের ঘাড়ে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ

বিজয় রায় খোকা, কিশোরগঞ্জ
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৮:০০আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:১৮

ধান হারানো হাওরের কৃষকের ঘাড়ে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ উজানের ঢলে আগাম বন্যায় এপ্রিলের মাঝামাঝিতে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় কিশোরগঞ্জের হাওরের বেশিরভাগ ধানি জমি। ফলে বছরের একটি মাত্র ফসল হারায় কৃষকরা। ফসল হারিয়ে ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে ঘুরছেন তারা। চলতি বছর আগাম বন্যায় জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও তাড়াইল উপজেলার কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই পাঁচ উপজেলায় বিভিন্ন  ব্যাংক, এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে কৃষকরা প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ফসল হারিয়ে দিশেহারা হাওর অঞ্চলের কৃষকরা বুঝতে পারছেন না কিভাবে এ ঋণ শোধ করবেন।

প্রায় প্রতি বছরই এমন দুর্যোগের শিকার হয় হাওর পাড়ের কৃষকরা। এ বছর পানি বেশি আগে চলে আসায় ঘরে আর ফসল তুলতে পারেনি তারা।

বন্যার পর সরকার ব্যাংক, এনজিকে আপাতত কৃষি ঋণ আদায় করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু সে নির্দেশ মানছে না এনজিওগুলো। প্রায় প্রতিদিনই গ্রামে গ্রামে গিয়ে টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি চাপ দিচ্ছেন মহাজনরা। চড়া সুদে নেওয়া মহাজনী ঋণ শোধ করতে গিয়ে কেউ কেউ নিজের জমির কিছু অংশ লিখে দিচ্ছেন। অনেকে কাজের খোঁজে ও ঋণের চাপ থেকে রক্ষা পেতে ছুটে চলে গেছেন বিভিন্ন শহরে।

মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোর ইউনিয়নের বাসিন্দা রহিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘মহাজনের কাছ থেইক্যা ৫০ হাজার টেহা ধার লইয়্যা ধান চাষ করছিল আমার স্বামী। এহন হেই টেহার লাইগা দিন-রাইত এক হইয়া গেছে। পরতেক দিন টেহার লাইগ্যা আইয়া কইয়া যায়। আর আমার স্বামী হেই টেহার লাইগ্যা ঘর-সংসার ফালাইয়া শহরে কামলা দিতাছে। কেমনে অত টেহা দিয়াম বুঝতাম পারতাছি না।’

ধান হারানো হাওরের কৃষকের ঘাড়ে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ ইটনা উপজেলার বড়িবাড়ি ইউনিয়নের আক্কাছ মিয়া বলেন, ‘যে পরিমাণ জমি চাষ করছিলাম তার অর্ধেকটাই নষ্ট হইছে এইবারের বন্যায়। নিজের জমাইন্যা টেহা আর এনজিও থেইক্যা কৃষি ঋণ লইয়া চাষের কাজ শুরু করছিলাম। ভাবছিলাম এইবারের ফসল উঠলে লাভের টাকাও থাকবো। আর এনজিওর টাকাও শোধ করমু। কিন্তু আসল লাভ সবডাই পানির নিচে। নিজের টেহা তো গেলই। এখন এনজিও'র তাগদায় কোনও কূল-কিনারা পাইতাছি না। ঘরে বৃদ্ধ মা, ছুডু ছুডু দুইটা বাইচ্যা আর বউ লইয়া সংসার টিকাইয়া রাখতেই আমার মরার অবস্থা। এহন কেমনে এই ঋণের টাকা শোধ করুম, বুঝতাছি না।’

অষ্টগ্রাম উপজেলার বাঙালপাড়া ইউনিয়নের কুতুব আলী মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ঋণের বোঝার চাইতে অহন মরণ ভালা। ঘরে খাওন নাই, কাজ-কাম নাই, এর মইদ্যে আবার দেনা। বন্যায় যে ক্ষতি আমার হইছে অহন কেমনে হেই ক্ষতি পুষাইমু। আমার আর দুই পুলা ঋণ মিডাইতো টেহা আনতো শহরে কই কই ঘুরতাছে কোনও খোঁজ পাই না। আমি তো বৃদ্ধ মানুষ বাড়িত থাকি আর ঋণের তাগদা হুনতে অয়। নাইলে জমি-জমা যতটুক আছে হেইডাও বেঁচন লাগবো।’ সরকার থেকে ভিজিএফ ও নগদ অর্থ দিলেও তা দিয়ে সংসার চালাতে পারছেন না তারা।

এ ব্যাপারে পূর্ব অষ্টগ্রাম ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কাছিদ মিয়া বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থেকে সহযোগিতা করছি। কিন্তু গোপনে এনজিও কর্মীরা কৃষকদের ওপর চাপ দিচ্ছে টাকা দেওয়ার জন্য । মহাজনরা তাদের দিনে-রাতে হুমকি দিচ্ছে টাকা পরিশোধের । আগামী শুকনো মৌসুমে বোরো ধান ভালোভাবে আবাদ করে ঘরে তোলার আগে কৃষকদের পাওনা টাকার চাপ দিলে কৃষকরা তা পরিশোধ করতে পারবে না।’

ধান হারানো হাওরের কৃষকের ঘাড়ে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান-হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত সব কৃষক সামনের মৌসুমে যেন বোরো আবাদ সঠিকভাবে করতে পারে সেজন্য সরকার একটি প্যাকেজ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে । প্রতিটি কৃষককে সার, বীজ, কীটনাশকসহ চাষাবাদের যাবতীয় জিনিসপত্র বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। হাওরের পানি কমে গেলেই এই কার্যক্রম শুরু হবে। ক্ষতিগ্রস্ত সব কৃষকের তালিকা আমাদের হাতে রয়েছে ।

ফসল হারানো কৃষকরা নদীতে অবাধে মাছ ধরার সুযোগ চেয়েছিলেন। সে উপায়ও নেই। কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার সব জলমহাল ইজারাদারদের হাতে। সেখানে কৃষক বা জেলেদের মাছ ধরার কোনও অধিকার নেই। মাছ ধরা তো দূরের কথা, এ দুর্যোগের পর ইজারাদাররা আরও কঠোর আচরণ করছে।

জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা জানিয়েছে, জেলায় ছোটবড় মিলিয়ে ১৯০টি জলমহাল রয়েছে। এর মধ্যে নদীও রয়েছে বেশকিছু। এগুলো সবই আবার ইজারা দেওয়া।

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার সুতারপাড়া ইউনিয়নের একটি হাওর গ্রাম চংনোয়াগাঁও। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধনু নদী। এ গ্রামে জেলের এখন মাত্র কয়েক ঘর জেলে রয়েছে। তারাও অসহায়। হাওরে ধান চাষের পাশাপাশি যে নদীতে তারা মাছ ধরে মোটামুটি স্বচ্ছল জীবনযাপন করতো সেই গ্রামের লোকজনের হাতে এখন কোনও কাজ নেই। খাওয়ার জন্য মাছও ধরার উপায়ও নেই। চারদিকে ইজারাদারদের চোখ রাঙানি আর ভয়ভীতি।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক আজিমুদ্দিন বিশ্বাস জানান, নদ-নদী উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাপারটি নীতি-নির্ধারণী বিষয়।এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে উপর মহলে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।

 

/এসটি/আপ-এনআই
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’