X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘টিফিনের সময় পেট ভইরা কলের পানি খাই’

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, খাগাউড়া গ্রাম থেকে ফিরে
১৬ অক্টোবর ২০১৭, ০৯:০৮আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ০৯:১৫

‘টিফিনের সময় পেট ভইরা কলের পানি খাই’ ‘টিফিনের সময় পেডে খিদা লাগে, তখন পড়ালেখা ভাল্লাগে না। খেলাধুলা কইরা পেট ভইরা কলের পানি খাই’― এভাবেই কষ্টের কথা জানায় সুনামগঞ্জের খাগাউড়া কান্দাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী প্রাপ্তি সরকার।

একই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী লিজা সরকার জানায়, তারা দুই ভাই, দুই বোন। বাবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদের নিজস্ব জায়গা জমি বলতে কিছুই নেই। অন্যের জায়গায় ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে বসবাস করছে। বছরের এ সময় তার বাবা প্রবীর সরকার হাওরে মাছ ধরেন। যেদিন জালে মাছ ধরা পড়ে সেদিন খাবার জোটে আর যেদিন জালে মাছ লাগে না সেদিন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে।

স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সজীব রঞ্জন তালুকদার জানায়, তার বাবা প্রদীপ তালুকদার স্থানীয় খাগাউড়া বাজারে নাইটগার্ড হিসেবে কাজ করেন। তারা তিন ভাইবোন। এ বছর অকাল বন্যায় ফসলহানির পর কোথাও কোনও কাজ না পেয়ে তার বাবা নামমাত্র বেতনে গ্রাম্যবাজারে পাহারাদারের চাকরি করেন। সংসারে আয়-রোজগারের অন্য কেউ নেই। তাই খেয়ে না খেয়ে কোনও রকমে দিন কাটছে।

শ্রেণিকক্ষে প্রাপ্তি সরকার

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়া চৌধুরী জানায়,তার বাবা একজন বর্গাচাষি। তারা তিন ভাই, এক বোন। ঋণ করে এ বছর বোরো চাষাবাদ করেছিলেন বাবা। কিন্তু ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায়  গরু বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেছেন। এখন তার বাবা হাওরে চিংড়ি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিনোদ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘এলাকার সবাই গরিব ঘরের সন্তান। এজন্য স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও খুব কম। স্কুলের হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা এ সময় হাওরে শাক-পাতা তোলা, গোবর সংগ্রহ, মাছ ধরাসহ বিভিন্ন আয়-রোজগারমূলক কাজে বাধ্য হয়ে নেমে যায়। পেটে ভাত নাই, তাদের আটকাতেও তো পারি না।’

তিনি বলেন, ‘স্কুলে নতুন বই বিতরণের সময় অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে শিক্ষার্থীদের যে উপস্থিতি থাকে সারা বছর এই ধারাবাহিকতা থাকে না। বিশেষ করে বর্ষাকালে স্কুলে শিক্ষার্থীদের হার অনেক কমে যায়।’

‘টিফিনের সময় পেট ভইরা কলের পানি খাই’

খাগাউড়া কান্দাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১২৪ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এদের মধ্যে ছেলে ৬০ জন ও মেয়ে ৬৪ জন। স্কুলের সহকারী শিক্ষক পূর্ণিমা রাণী তালুকদার বলেন, ‘গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতার প্রচণ্ড অভাব। অভিভাবকদের বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর আগ্রহ কম।’

একই স্কুলের সহকারী শিক্ষক মিশন তালুকদার বলেন,‘স্কুলের শতভাগ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায়। উপবৃত্তির টাকা অভিভাবকরা সাংসারিক কাজে খরচ করে ফেলেন। যৎসামান্য টাকা শিক্ষার্থীদের কোনও কাজে লাগে না। তার চেয়ে মিড ডে মিল বা স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু করলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মান কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে।’

বার্ষিক শিশুজরিপ অনুযায়ী দিরাই উপজেলার রফিনগর ইউনিয়নের খাগাউড়া গ্রামে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। যারা দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। হাওরে মাছ ধরা আর কৃষিকাজ ছাড়া বিকল্প কোনও কর্মসংস্থান নেই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের। মাছ ধরতে না পারলে বছরের ছয় মাস বেকার থাকেন গ্রামের উপার্জনক্ষম লোকজন।

‘টিফিনের সময় পেট ভইরা কলের পানি খাই’

একই গ্রামের খাগাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে খাগাউড়া গ্রামের ক্যাচমেন্ট এরিয়া নয়াহাটি, পশ্চিমহাটি, মাঝেরহাটি, পুকুরপাড়, বড়হাটি, ঠাকুরহাটি পাড়ার ১৮৪ জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৭৩ জন এ স্কুলে লেখাপড়া করে।

স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিতু তালুকদার জানায়, তারা এক ভাই, চার বোন। বাবা নাই। একমাত্র বড় ভাই তাদের সংসার চালান। ভাই গ্রামে দিনমজুরের কাজ করেন। প্রতিদিন গ্রামে কাজ মিলে না। তাই অনেক কষ্ট করে তাদের চলতে হচ্ছে। 

একই স্কুলের শিক্ষার্থী তিথি, অশেষ, রুদ্র ও শঙ্কর জানায়, তারা সকাল সাড়ে ১১টায় স্কুলে আসে আর ক্ষুধা লাগলে ২টার পর বাড়ি চলে যায়। বাড়ি গিয়ে ভাত জুটলে খায়, নইলে না খেয়ে থাকে। পরে একবারে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জলী রানী তালুকদার বলেন, ‘স্কুলের ছোট ছোট শিশু সকাল ১১টায় স্কুলে আসে। টানা ৪টা পর্যন্ত ক্লাস করে। ২টার দিকে টিফিন আওয়ারে স্কুলে শিশুদের খাবারের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় ৩টার পর থেকে স্কুল ছুটি দেওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেয়। ফলে অনেকদিন মানবিক কারণে ক্লাস না করেই তারা বাড়ি ফিরে যায়। স্কুলে শতভাগ উপবৃত্তি নিশ্চিত হলেও এতে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই দুর্গম হাওর এলাকার স্কুলগুলোতে মি ডে মিল বা স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু করলে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর মান উন্নয়ন হতো।’

‘টিফিনের সময় পেট ভইরা কলের পানি খাই’

জামালগঞ্জ উপজেলার রহিমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আকমল  হোসেন বলেন, ‘হাওর এলাকার সব স্কুলগুলোর একই অবস্থা। উপবৃত্তির পরিবর্তে মিড ডে মিল বা স্কুল ফিডিং কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে হাওর এলাকায় মানসম্মত শিক্ষার্থী তৈরি হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে।’

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, স্কুলের শিক্ষার্থী হাজিরা খাতায় উপবৃত্তি নিশ্চিতের জন্য অভিভাবকরা চাপ সৃষ্টি করে।তাই অনেক সময় কোনও শিক্ষার্থী স্কুলে অনুপস্থিত থাকলেও কাগজে প্রতিদিন উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।

জেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাজ্জাদ জানান, জেলার ১১টি উপজেলার এক হাজার ৪২৫টি স্কুলে এক লাখ ৯৮ হাজার ৯৩০ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। তারা সর্বোচ্চ তিনশ টাকা করে উপবৃত্তি পাচ্ছে। এছাড়া ধর্মপাশা উপজেলার ১১টি স্কুলে মিড ডে মিল কর্মসূচি চালু রয়েছে। স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতায় ৪০ হাজার ৭৫৫ জনকে হাই প্রোটিন বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে। সরকার যদি হাওর এলাকার সব স্কুলে মিড ডে মিল বা স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু করে তাহলে হাওর এলাকার অন্যান্য স্কুলের শিক্ষার্থীরা এর সুফল পাবে।

 

 

/বিএল/টিএন/আপ-এসটি
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছে
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন