কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা মানুষের ঢলে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গাদের দখল-দূষণসহ তারা এখন বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। ভিটে-বাড়ি থেকে শুরু করে চাষের জমিটুকুও চলে গেছে শরণার্থীদের দখলে। নির্দিষ্ট জায়গায় রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর না করলে আরও বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারে সহিংসতার পর থেকে আশ্রয়ের জন্য দলে দলে পালিয়ে আসে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাদের আসা এখনও অব্যাহত আছে। এসব রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ১২টি ক্যাম্পে। এর মধ্যে উখিয়ায় সাতটি ও টেকনাফে রয়েছে পাঁচটি ক্যাম্প।
এছাড়া পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আরও অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা। নতুন-পুরনো মিলে এখন শরণার্থীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৯ লাখ। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে উখিয়া-টেকনাফের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ।
রোহিঙ্গা আশ্রিত ক্যাম্পগুলোর সঙ্গেই আছে স্থানীয়দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতি ও চাষযোগ্য জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এ কারণে অনেকের ভিটে-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও চাষাবাদের জমি অঘোষিতভাবে চলে গেছে রোহিঙ্গাদের দখলে।
একইভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের মতো মানবিক বিপর্যয়ের শিকার তারাও। তাই তাদের জন্যও চাওয়া হচ্ছে সরকারি সাহায্য।
উখিয়ার বালুখালী ২ নং ক্যাম্পের বালুখালীরছড়া এলাকার কলেজছাত্র আজিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, প্রায় দুই যুগ ধরে বালুখালীরছড়া এলাকায় হাজার হাজার গ্রামবাসীর বসতি। এখানে তার পাঁচ একর জমি আছে। বাড়ির পাশে চাষযোগ্য জমিও কম ছিল না। বাড়ির পাশের বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ আশ্রয় নেয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা। এ কারণে হাতছাড়া হয়েছে আজিজের মতো অনেকের জমি। কারণ এখন সবখানে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ও বসতি।
একই গ্রামের বনকর্মী কবির আহমদ ২০ বছর ধরে এই বনভূমিতে বসবাস করছেন। পাশাপাশি বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন স্থানীয় বনবিভাগকে। কিন্তু তিনিও বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘সব বনাঞ্চল ও পাহাড় চলে গেছে রোহিঙ্গাদের দখলে। এ কারণে আমাদের আগামী দিনগুলো চলতে কষ্ট হবে।’
উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া গ্রামের তরুণ আবুল কালামের অভিযোগ— রোহিঙ্গারা এসে শুধু বসতি নয়, সবুজ গাছগাছালি কেটে সাবাড় করে ফেলেছেন। তার ভাষ্য, ‘পাহাড়ের মাটি কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের মূল ও শেকড় উৎপাটন করছেন রোহিঙ্গারা। এসব শরণার্থী একের পর এক পাহাড় কাটলেও স্থানীয় বনবিভাগ যেন অসহায়। তবে বন্য হাতিরা কিছুদিন আগে আক্রমণ করে একই পরিবারের আট জন রোহিঙ্গাকে মেরেছে।’
রোহিঙ্গা যে এখন একটি বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা মানছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডিজি কবির বিন আনোয়ার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘উখিয়া ও টেকনাফ মিলে জনসংখ্যা রয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ। সেখানে যদি আরও ৯ থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় তাহলে বোঝা যায়, নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক সামাজিক বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। একইভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তো আছেই। ইয়াবা, অস্ত্র চোরাচালান ও মানবপাচারকারীসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কাও রয়েছে। তবে বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’
এদিকে সীমান্তে রোহিঙ্গাদের স্রোত এখনও থামেনি। উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসছে। এছাড়া সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে শরণার্থীদের ঢল এখনও অব্যাহত আছে। এসব রোহিঙ্গাকে তাৎক্ষণিক নিয়ে আসা হচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে।
আরও পড়ুন: