X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীতে অভিযানের ফোঁকড় গলে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ

দুলাল আবদুল্লাহ, রাজশাহী
২০ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:১৯আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:৩২

 

 

নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজশাহীতে পদ্মানদীতে চলছে ইলিশ শিকার

রাজশাহীতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলছে ইলিশ ধরা বন্ধে নিয়মিত অভিযান। তবে সুকৌশলে পদ্মা নদীতে নেমে অসাধু জেলেদের ইলিশ ধরাও থেমে নেই। আর  তা পাড়া-মহল্লায় প্রকাশ্যে বিক্রি করছে আরেক দল ফেরিওয়ালা। এসব বিষয়ে জেলা মৎস্য অফিসের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, আধুনিক নৌযান না থাকায় জেলেদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না তারা। আর জেলেরা বলছেন,সরকারি বরাদ্দের চাল না পাওয়ায় পেট চালাতে বাধ্য হয়ে তারা আইন লঙ্ঘন করছেন।

জানা গেছে, রাজশাহী জেলার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় অবাধে ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে বাঘা উপজেলায় প্রায় ১৫ থেকে ২০টি জেলে গ্রুপ মা ইলিশ ধরে বিক্রি করছে। তারাই বলছেন, দিনের চেয়ে রাতে ইলিশ শিকার হয় বেশি। বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে এক দফা নদীতে জাল ফেলে সন্ধ্যায় মাছ নিয়ে তাদের একদল আসছে নদীর তীরে। রাতে আরেক দফা নদীতে জাল ফেলে সকালে মাছ নদীর তীরের ঝোপে-জঙ্গলে, কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। এরপর সুযোগ বুঝে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। সরকারি নির্দেশ অমান্য করছে ক্রেতারাও। তারা অবৈধভাবে শিকার করা ইলিশ কিনতে জেলে পাড়া ও নদীর বিভিন্ন পাড়ে ছুটে আসছে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, বাইসাইকেলে চেপে,নিষিদ্ধ সময়ের ইলিশ কিনে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাগ বোঝাই করে।

সোমবার বাঘা উপজেলার পলাশী ফতেপুর এলাকার আকতার হোসেন ৪০০ টাকা কেজি ধরে দুই কেজি ইলিশ ক্রয় করেন। এই উপজেলার পিরোজ গ্রামের আরেক গৃহবধূ রোজিনা খাতুন ৫ কেজি ইলিশ মাছ ক্রয় করেন। তিনি ফেরিওয়ালা এক যুবকের কাছ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা দরে ইলিশ কিনেছেন। আরেক ক্রেতা বাবু তার বন্ধু আসলাম উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে রাওথা গ্রাম থেকে ছয় কেজি মাছ কিনেছেন ৪০০ টাকা দরে। তারা জানান, জাটকা ও ডিমওয়ালা মাছ রাওথা গ্রামের প্রায় বাড়িতে বাড়িতে। প্রথমে মাছ নাই বলে জানালেও ক্রেতা হিসেবে আশ্বস্ত হলে তাদের কাছে মাছ বিক্রি করে থাকেন এ গ্রামের জেলেরা।

ফেরি করে ইলিশ বিক্রি করছেন জাকির নামের এক যুবক। তিনি জানান, চকরাজাপুর এলাকার ঘাট থেকে মাছগুলো কিনে তিনি পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কথা তাকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘কী করবো, আমাদেরকে তো বেঁচে থাকতে হবে। ’

হাট বাজার ছেড়ে পাড়ায়-পাড়ায় ইলিশ মাছ বিক্রির বিষয়ে জানতে আরেক বিক্রেতা রবিউল ইসলাম বলেন, জেলেরা ধরছে আর আমরা ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে বিভিন্ন গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করছি। মাছগুলো আলাইপুর এলাকার ঘাট থেকে ক্রয় করা হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে বাঘা উপজেরার দিঘা এলাকায় আরিফুর রহমান নামের আরেক ব্যবসায়ী কোনও উত্তর না দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।

বাঘা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম বলেন, হাট-বাজারে কোথাও ইলিশ বিক্রি হয় না। তবে চুরি করে কিছু অসাধু জেলে মাছ ধরে বিক্রি করছে এটা সত্যি।

গোদাগাড়ী উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামের খুদিরাম মণ্ডল (৫০), সারাংপুর গ্রামের আলম (৪৫),আব্দুল আহাদ জনি (২০) নামের জেলেরা জানান, তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ শিকার করতে গিয়েছিলেন। অভিযানে তারা ধরাও পড়েছিলেন। কিন্তু গরিব হওয়ায় সংসার চালানোর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞার পরও পদ্মা নদীতে মাছ শিকারে যাচ্ছেন তারা। সরকার যদি এসময় আমাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করে রাখতো তাহলে ঝুঁকি নিয়ে আমরা মাছ শিকার করতে নদীতে নামতাম না।

রাজশাহী জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর চারটি উপজেলায় ১০৫ কিলোমিটার পদ্মা নদীতে মাছ ধরে ৭ হাজার ৫৭৪ জন (পবা উপজেলায় ২০৫৮, গোদাগাড়ী উপজেলায় ২৪৩৪, চারঘাট উপজেলায় ১১৭৫ ও বাঘা উপজেলায় ১৩০৭) নিবন্ধিত জেলে। এরমধ্যে নদী তীরবর্তী ১ হাজার ৮০০ জেলেকে দুস্থ ও ইলিশ শিকারি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের জন্য এবারই প্রথম গত ১৫ অক্টোবর দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৩৬ মেট্রিক টন চালের বরাদ্দ এসেছে। প্রত্যেক জেলেকে আজ ২০ অক্টোবরের মধ্যে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। এরমধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৩৮, পবা উপজেলায় ৪৫৩, গোদাগাড়ী উপজেলায় ৫৭৯, চারঘাট উপজেলায় ২৭৯ ও বাঘা উপজেলায় ৩১১ জন জেলে রয়েছে।

এ ব্যাপারে রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুভাস চন্দ্র সাহা বলেন, অভিযান শুরু আগেই জেলেদের জন্য চাল বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে দেরি করে চাল আসায় আমরা সঠিক সময়ে দিতে পারেনি।

তাহলে কী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরছে জেলেরা—এমন প্রশ্নের জবাবে রাজশাহী জেলা মৎসা কর্মকর্তা সুভাস চন্দ্র সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কয়লা ধুয়ে ময়লা যায় না। অভিযান চালানোর পরও তারা (জেলেরা) নদীতে মাছ শিকারে যায়। আর আমাদের এখানে স্পিড বোট নেই। তাই আমরা নৌকা ভাড়া করে তাদেরকে ধাওয়া করলে উচ্চগতিসম্পন্ন নৌকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এতে করে তাদের শিকার করা মাছগুলো শহরে নয়, পাড়া-মহল্লায় গোপনে বিক্রি করছে। আমাদের পর্যাপ্ত জনবলের অভাব থাকার পরও নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। গত বছর থেকে অভিযান চালানোর ফলে পদ্মা নদীতে অন্য সময়ের তুলনায় প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া গেছে। যা আগে পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও বলেন, ১ অক্টোবর থেকে ১৭ অক্টোবর বিকেল পর্যন্ত ২০০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৪৮ হাজার টাকা ২০০ জরিমানা করা হয়েছে। ১৩টি মামলা করা হয়েছে। ২ লাখ ৩৫৩ হাজার ৬৬০ মিটার জাল পোড়ানো হয়েছে। যার মূল্য আনুমানিক ৫২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে ১১জন জেলেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে গত ১৬ অক্টোবর গোদাগাড়ীতে অভিযান চালিয়ে তিন জেলেকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এরা হলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বকচর গ্রামের মৃত আব্দুর বশিরের ছেলে আববার আলী (৩৫), একই জেলার জেলহাটি গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে তারেক রহমান (৩২) ও রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চরবয়ারমারী গ্রামের মুনসর আলীর ছেলে হেলাল উদ্দিন।

এদিকে, ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সাজা ও জরিমানা অব্যাহত রয়েছে। গত মঙ্গলবার বিকালে রাজশাহীর নবগঙ্গাহাট এলাকার পদ্মা নদীতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ মাছ ধরার অপরাধে আট জেলেকে এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর কবীর এই রায় প্রদান করেন।

রাজশাহী র‌্যাব-৫ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর এএম আশরাফুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার বিকেলে র‌্যাব সদস্যরা রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার নবগঙ্গা এলাকার পদ্মা নদীতে অভিযান চালায়। এসময় নিষিদ্ধ মৌসুমে ইলিশ শিকার করার অপরাধে আট জেলেকে আটক করা হয়। অভিযানের নেতৃত্বে থাকা পবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলমগীর কবীর এসময় আটক আট জেলের প্রত্যেককে এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। পরে তাদের থানা পুলিশের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে এসময় র‌্যাব সদস্যরা নদী থেকে মাছ ধরার সময় দশ হাজার মিটার কারেন্ট জাল ও দেড়শ কেজি ইলিশ মাছ জব্দ করেন। পরে জাল পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। উদ্ধার করা ইলিশ মাছগুলো এতিমখানায় দেওয়া হয়।

 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা