X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ময়মনসিংহে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে কোনও কমান্ডার ছিলেন না

আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ
০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:৪৯আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৫৭

এই সেই ঐতিহাসিক খাকডহর যুদ্ধের ময়দান,পেছনে ব্যারাক বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে কোনও কমান্ডার ছিলেন না। সাধারণ সৈনিকরাই টানা ১৫ ঘণ্টা যুদ্ধ করে ক্যাম্পের সব পাকিস্তানি সেনাকে খতম করেন। অথচ এই বীরত্বের ঐতিহাসিক কোনও দলিলপত্র নেই, নেই রাষ্ট্রীয় প্রচারণা। ফলে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হতে শুরু করেছে ভাটির দামালদের বীরগাথা। বিজয়ের মাসে এসে বাংলা ট্রিবিউনকে সেই অসম যুদ্ধে অমিত বিক্রমের বিজয়স্মৃতি শুনিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বিমল পাল, ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার নাজিম উদ্দিন আহমদ এমপি, তৎকালীন ইপিআর জওয়ান শেখ মো. হারুন অর রশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রাত ১২টা থেকে পরদিন বিকাল ৩টা পর্যন্ত ১৫ ঘণ্টার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ১০৪ জন আক্রমণকারী পাকিস্তানি সেনা প্রাণ হারায়। এ সময় আটক ১৭ পাকিস্তানি সেনাকে ট্রাকে করে শহর ঘোরানোর পর বন্দি করা হয় ময়মনসিংহ জেলে। বিপরীতে পাকিস্তানি সৈন্যদের ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে দেশকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হন বাঙালি জওয়ান দেলোয়ার, আবু তাহের, আনোয়ার হোসেন, এমদাদুল হক, অজিত দত্ত ও আব্দুর রাজ্জাক। 

এ যুদ্ধ এলাকার মানুষের মুখে মুখে ‘খাকডহর’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। খাকডহর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করার পর তাদের ক্যাম্প থেকে ১ হাজার ৪০০ রাইফেল, ১ লাখ ৩৫ হাজার গুলি, ২৮টি এলএমজি, ৩৬ হাজার নাইন এমএম গুলি বাঙালিদের হাতে চলে আসে। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। সেই ইপিআর ক্যাম্পে পরবর্তীতে বানানো শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ

ইপিআর ক্যাম্পের সাবেক জওয়ান ও মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. হারুন অর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মার্চের গোড়ার দিকে মেধাবী সেনা কর্মকর্তাদের ময়মনসিংহ খাকডহর ইপিআর ক্যাম্প থেকে প্রত্যাহার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় তৎকালীন সরকার। কিন্তু ২৫ মার্চ ঢাকার পিলখানা আক্রমণের পর থেকেই ময়মনসিংহের খাকডহর ইপিআর ক্যাম্পের অবাঙালি কমান্ডার ও সৈনিকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করেন বাঙালি জওয়ানরা। খাকডহর ক্যাম্পের ভেতর থেকে বাঙালি জওয়ানদের মাধ্যমে এই খবর চলে যায় ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মরহুম রফিক উদ্দিন ভুইয়ার কাছে। ফলে ক্যাম্পের বাঙালি জওয়ানদের পাশাপাশি ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় জনতার মধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধের একটি ঘরোয়া প্রস্তুতি চলতে থাকে।

২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার সেনারা খাকডহর ক্যাম্পের ক্যাপ্টেনের বাংলোয় এসএমজি, এলএমজিসহ ভারী ও আধুনিক অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ করে। এর তিন দিন আগে বালুচ এয়ারফোর্সের ১২টি গাড়ি আনা হয় ইপিআর ক্যাম্পে। বাঙালি জওয়ানদের ব্যারাকের সামনে খনন করা হয় বাংকার। এই বাংকারের সামনেই রাখা হয় ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বালুচ এয়ারফোর্সের সব গাড়ি। ময়মনসিংহ আক্রমণের পরিকল্পনা থেকেই এসব করা হয়।

পিলখানা আক্রমণের পর খাকডহর ইপিআর ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনা কমান্ডার ও অবাঙালি জওয়ানরা ২৭ মার্চ বিকাল ৪টায় এক সভা আহ্বান করে। ওই সভায় এক কোম্পানি জওয়ান যোগ দেয়। এ সময় পাকিস্তানি সেনা কমান্ডাররা ক্যাম্পের বাঙালি জওয়ানদের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। একই দিন রাতে ‘বড়খানা’র আয়োজন করা হয় ক্যাম্পে। পাকিস্তানি সেনাদের এসব ঘটনা বাঙালি জওয়ানদের ভাবিয়ে তোলে। তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্পের একাংশ, বর্তমানে বিজিবি’র সেক্টর সদর

বিকালের সভার পর পাকিস্তানি কমান্ডারের আদেশ অমান্য করে অস্ত্র জমা না দিয়েই ব্যারাকে ফিরে যান বাঙালি সেনারা। এরপর জওয়ান নান্নু, আফতাব, আনিস, জয়নাল, কাজী সাঈদ, বাবু, মান্নান ও ফরহাদসহ ক্যাম্পের ১৫০ বাঙালি জওয়ান আলোচনা করে প্রতিরোধের পরিকল্পনা করেন। পরে তারা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাতের ‘বড়খানা’য় অংশ নেন। ‘বড়খানা’র পর থমথমে হতে শুরু করে ক্যাম্পের পরিবেশ। রাতে জওয়ানদের নিয়মিত টহল প্রত্যাহার করে দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানি সেনা কমান্ডারদের। পরিস্থিতি পর্যাবেক্ষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন বাঙালি সেনারা। আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা।

ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১২টা ১০ মিনিট। ক্যাম্পের ভেতরের পরিবেশ তখন পুরোটাই থমথমে। এ সময় হঠাৎ করে ইপিআর ক্যাম্পের পাকিস্তানি কমান্ডারের বাংলো থেকে ব্যারিলাইট পিস্তলে ছোড়া গুলির আলোতে সচকিত হয়ে ওঠে পুরো ক্যাম্প এলাকা। এটি ছিল বাঙালি জওয়ানদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের গ্রিন সিগন্যাল। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে আত্মরক্ষার্থে আক্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বাঙালি জওয়ানরা। এরপর টহলে থাকা পাকিস্তানি হাবিলদার ওমরজান ও খটকের ওপর অতর্কিত ব্রাশ ফায়ার শুরু করেন বাঙালি সিপাহি নান্নু। একই সময়ে ব্যারাকের সামনে রাখা গাড়ি ও বাংকার লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন হারুন, নান্নু, আফতাব, জয়নালসহ অন্যান্য বাঙালি জওয়ানরা।

পাশাপাশি অস্ত্রাগার ও ব্যারাক লক্ষ্য করে চলে বাঙালি জওয়ানদের গুলিবর্ষণ। ফজরের আজানের পর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে ক্যাম্প এলাকা। একপর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে ক্যাম্পের পেছন দিক দিয়ে রেললাইন ধরে ঘুন্টির দিকে পালাতে শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। বাঙালি জওয়ানরা প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা ধাওয়া করে তাদের অনেককে ধরে ফেলেন।

রাতভর গুলির ঘটনা ও ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়লে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই সুতিয়াখালি, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, দীঘারকান্দা, চুরখাই, বিদ্যাগঞ্জ, দাপুনিয়া, শম্ভূগঞ্জ বাজার, চর ঈশ্বরদিয়া, চর নিলক্ষীয়া, ত্রিশালের কালির বাজার ও মুক্তাগাছাসহ শহরের আশপাশের প্রায় ৩০-৪০ হাজার জনতা পুরাতন আমলের গাদা বন্দুক, রামদা, লাঠি, বল্লম, ছুরিসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ইপিআর ক্যাম্পের চারপাশ ঘিরে ফেলে। সকালের দিকে মিছিলসহ ক্যাম্পের সামনে আসেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম রফিক উদ্দিন ভুইয়া, সৈয়দ সুলতান, ম. হামিদ, অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন আহমদসহ আরও অনেকে। তখনও ভেতর থেকে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। বিকাল ৩টার দিকে থেমে যায় গুলির শব্দ। তখন বাঙালি জওয়ান আর স্থানীয় জনতা মিলে ১৭ জন হানাদারকে জীবিত অবস্থায় আটক করেন এবং ১০৪ জনকে যুদ্ধের সময় খতম করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বিমল পাল ও ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার নাজিম উদ্দিন আহমদ জানান, এ বিজয়ের খবর পেয়ে পরে তৎকালীন মেজর একেএম শফিউল্লাহ এসেছিলেন ক্যাম্প দেখতে। এ বিজয় ময়মনসিংহবাসীকে বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। 

/এএইচ/বিএল/ আপ- /এসএসএ/
সম্পর্কিত
নানা আয়োজনে রাজধানীবাসীর বিজয় উদযাপন
বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা
জাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
সর্বশেষ খবর
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়