X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অভয়াশ্রম ছিল তেঁতুলিয়া

পঞ্চগড় প্রতিনিধি
০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:৪০আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:৪৯

এখান থেকে তেঁতুলিয়া মুক্তাঞ্চলের শুরু (ছবি- প্রতিনিধি)

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই মুক্ত ছিল পঞ্চগড়ের  তেঁতুলিয়া। মুক্তাঞ্চল হিসেবে এই ৭৪ বর্গমাইলের মানুষের জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক। বিয়ে, খতনা, আকিকাসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করেছে এখানকার মানুষ। নিরুপদ্রব হওয়ায় তেঁতুলিয়া যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকাণ্ডের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়। এখান থেকে উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ রিক্রুটিং, প্রশিক্ষণ, অস্ত্রের জোগান দেওয়া ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত ছিল পঞ্চগড় জেলা। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা পঞ্চগড় দখলে নেয়। এ দিনে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে না পেরে উত্তরের দিকে পেছাতে থাকেন। শেষমেশ তারা (মুক্তিযোদ্ধারা) আশ্রয় নেন মাগুরমারী এলাকায়। তবে এর আগে পাকিস্তানি সেনারা যাতে তেঁতুলিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তারা (মুক্তিযোদ্ধারা) পঞ্চগড়-তেতুলিয়া মহাসড়কের অমরখানা এলাকার চাওয়াই নদীর ব্রিজ (অমরখানা ব্রিজ) ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দেন। এতে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তেঁতুলিয়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগ্রাসনমুক্ত থাকে। এ কারণে ওই সময় তেঁতুলিয়া হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশের মডেল।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, তেঁতুলিয়া ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন ৬/ক সাব-সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল। ওই সময় এখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও কর্নেল ওসমানী এসেছেন। যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। সেক্টর কমান্ডার খাদেমুল বাশার, সাব-সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার, লে. মাসুদ ও লে. মতিন তেঁতুলিয়া থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।

মুক্তিযোদ্ধারা আরও জানান, ৬ নম্বর সেক্টরের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো তেতুলিয়া ডাকবাংলো। এ সেক্টরের কমান্ডার খাদেমুল বাশার ডাকবাংলোর একটি কক্ষে থাকতেন। অন্য কক্ষটি ছিল মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ও অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন আবুল মনসুরের জন্য। এ ডাকবাংলোয় যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকাণ্ডের সিদ্ধান্ত হয়। তেঁতুলিয়ার খুব কাছেই ছিল ভারতের জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং। মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর জন্য তাই তেঁতুলিয়া ছিল খুবই সুবিধাজনক একটি স্থান।

তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো (ছবি- প্রতিনিধি)

মো. মতিয়ার রহমান জানান, ১৭ এপ্রিল তিন দিকে ভারত বেষ্টিত সীমান্ত জেলা পঞ্চগড় দখল করে পাকিস্তানি বাহিনী এবং জেলা সদর, তালমা, গলেহা, মির্জাপুর, আটোয়ারী সদর, বোদা, ময়দানদীঘি, নয়াদিঘী, সাকোয়া, জগদল, অমরখানাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা তেঁতুলিয়ার পাশাপাশি ভারতের চাউলহাটি, কোটগছ, থুকরিবাড়ি, ভজনপুর, মাগুরমারী, ময়নাগুড়ি, দেবনগর, ব্রাম্মণপাড়ায় ক্যাম্প করে অবস্থান নেন। এছাড়া গেরিলা যোদ্ধারা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য হাইড আউটের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালান। পঞ্চগড়ে ৬ নম্বর সেক্টরের ৭টি কোম্পানির অধীনে ৪০টি মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

গেরিলা কমান্ডার মাহবুব আলম জানান, সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সদরউদ্দিন, ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার, লে. মাসুদুর রহমান, লে. আব্দুল মতিন চৌধুরী, মেজর কাজিমউদ্দিন, সুবেদার আব্দুল খালেক, গেরিলা যোদ্ধা কমান্ডার মাহবুব আলমসহ অন্যান্যদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হন।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম জানান, পঞ্চগড় দখলের দিন থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৭ এপ্রিল থেকে পঞ্চগড় সদর, তালমা, জগদলহাট, অমরখানা, শিংপাড়া, চৈতন্যপাড়া, বানিয়াপাড়া, মধুপাড়া, নিমাইপাড়া, থুকরিপাড়া, সোনারবান তালমা, মারেয়া, নয়াদীঘি, মন্ডলেরহাট, গলেয়া, জাবরীদুয়ার, ভজনপুর, মারেয়া, জমাদারপাড়া, টোকাপাড়া, চেকরমারী, ডাঙ্গাপাড়া, প্রধানপাড়া, ফকিরপাড়া, জোতহাসনা, সাহেবীজোত, শিথলীজোত, নুনিয়াপাড়া, ফকিরেরহাট, সিএন্ডবি মোড়, মীরগড়, গড়েরডাঙ্গা, টাঙ্গালী ব্রীজ, পানিমাছপুকুরী, মির্জাপুর, ধামোর, আটোয়ারী, পাটশিরীহাট, ঝলঝলি, তেলিপাড়া, দাড়িমনি, ছেপড়াঝাড়, দিঘীপাড়া, ধারিয়াখুড়ি, ডুংডুঙ্গিরহাট, গোয়ালপাড়া, পুরানাদিঘী, তড়েয়া, ডাঙ্গীরহাট, লাঙ্গলগাঁও, নয়াদিঘী, মানিকপীর, পেয়াদাপাড়া, কালিয়াগঞ্জ, সাকোয়া, ময়দানদীঘি ও বোদাতে যুদ্ধ চলতে থাকে। জুলাই মাসে এসব এলাকার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করে। নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর একের পর এক ক্যাম্পে হামলা চালায়। এতে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং নুতন নতুন এলাকা মুক্ত হতে থাকে।

জহিরুল ইসলাম আরও জানান, এর ধারাবাহিকতায় ২০ নভেম্বর অমরখানা, ২৫ নভেম্বর জগদলহাট, ২৬ নভেম্বর শিংপাড়া, ২৭ নভেম্বর তালমা, ২৮ নভেম্বর পঞ্চগড় সিও অফিস এবং একই দিনে আটোয়ারী ও মির্জাপুর মুক্ত হয়। এভাবে ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় মুক্ত হয়। দীর্ঘ সাড়ে সাত মাস ধরে চলা যুদ্ধে শহীদ হন অনেক মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ।

তেঁতুলিয়া উপজেলা ও পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বর্তমান প্রজন্মের কাছে তেঁতুলিয়াসহ এ জেলাকে পরিচিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর কাছে মুক্তাঞ্চলের স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া অমরখানার চাওয়াই নদীর (অমরখানা ব্রিজ) পাশে স্বাধীনতার মুক্তাঞ্চল নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

 

/এমএ/
সম্পর্কিত
নানা আয়োজনে রাজধানীবাসীর বিজয় উদযাপন
বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা
জাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন