X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা জীবন!

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার
১৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:৪৫আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৯:৩১

উখিয়ার বালুখালী এলাকায় পাহাড় দখল করে রোহিঙ্গা বসতি (ফাইল ছবি) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাগুলো এখন জনশূন্য। গত ২৪ আগস্ট রাত থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। বাঁচার তাগিদে পাহাড়ি ভূমি আর নাফ নদী পার হয়ে আসার সময় ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণেও প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। বাংলাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে আহতদের অনেকেকে। মিয়ানমার সেনাদের গুলি ও আগুন থেকে বাঁচতে ভূমিতে পুঁতে রাখা বোমার ফাঁদ পেরিয়ে নাফ নদী পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন যারা, তাদের অনেকেরই সলিল সমাধি ঘটেছে নাফের জলে। এরপরও আপাত স্বস্তি– কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে পাওয়া শরণার্থী জীবন।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাখাইন রাজ্যে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল, সে তুলনায় এখন অনেক ভালো আছে তারা। তবে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষার দিন গুনছে ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা। নিজ দেশে, নিজে ভূমিতে সম্মান ও প্রশান্তি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে থাকতে চায় তারা।

রোহিঙ্গা শিবিরে শিশু কোলে এক বৃদ্ধ (ফাইল ছবি) স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা ও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করেছে সরকার। একইসঙ্গে তাদের নিরাপদে নিজভূমে ফেরত পাঠানোর জন্য চুক্তি সম্পাদনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখা হয়েছে।

মৃত্যুর মুখ থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা জানান, এখানে ভালো আছেন তারা। তবে কিছু সমস্যাও রয়েছে। এর একটি হচ্ছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট। এছাড়াও বাসস্থান থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় বস্ত্র, পুষ্টিকর খাদ্য, নিরাপত্তা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সবকিছুতেই টানাটানি রয়েছে। চোখের সামনে স্বজনদের লাশ দেখে আসা স্মৃতি এখনও টাটকা। শরণার্থী ক্যাম্পে সম্মান নেই, নেই মর্যাদা; তবু এত সংকটেও যে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে, আপাতত এতেই খুশি তারা; কথা বলার সময় তাদের চোখে, মুখে ও কণ্ঠে ঝরেছে বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড় দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা (ফাইল ছবি)                                                                                           কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) রিপোর্ট জানায়, এবার নতুন করে ছয় লাখ ৪৮ হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। এছাড়া, ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরও আগে থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করছে।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ ও তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সুবিধার্থে এবার বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তাদের নিবন্ধিত করেছে সরকার। পাসপোর্ট অধিদফতরের মাধ্যমে গত রবিবার (১৭ ডিসেম্বর) পর্যন্ত আট লাখ ৫৬ হাজার ৮ জনের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও সমাজসেবা অধিদফতর ৩৬ হাজার ৩৭৩টি এতিম শিশু শনাক্ত করেছে। সব মিলিয়ে এখন ১২ লাখের ওপরে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে বলে বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে।

বিপুল সংখ্যক এই রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় তিন হাজার একর ভূমি বরাদ্দ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এসব জমিতে তাদের নিরাপদে থাকার জন্য অস্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ক্যাম্প। এ পর্যন্ত এক লাখ ৪৫ হাজার পরিবারের জন্য সরকারিভাবে ঘর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে বলেও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। স্থানীয়রা জানায়, সরকারের বরাদ্দ করা তিন হাজার একর ভূমির বাইরে আশেপাশের এলাকাতেও আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা ও পরিবেশ নিশ্চিতকরণে কাজ করছে জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনী। তাদের সহযোগিতা করার জন্য রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেই প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়েছে। এই প্রতিনিধিদের বলা হচ্ছে ‘সর্দার’। প্রতিটি ক্যাম্পে ১০০ থেকে ১২০টি পরিবার নিয়ে একজন সর্দার নিয়োগ করা হয়। তারা ‘রোহিঙ্গা মাঝি’ নামেও পরিচিত। উখিয়া ও টেকনাফের এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছে দেড় হাজার রোহিঙ্গা মাঝি। মূলত, তাদের সার্বিক সহযোগিতায় স্থানীয় প্রশাসন ও এনজিওসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন জানান, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসন। পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ক্যাম্পে ছয়টি পুলিশ ফাঁড়ির আওতায় কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেড় হাজার সদস্য। অপরাধ দমনে প্রতি রাতে বিশেষ অভিযান চালায় তারা। রোহিঙ্গারা যাতে দেশের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে না পারে সেজন্য পথে পথে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এসব চেকপোষ্টের মাধ্যমে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে আটকের পর ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে।  

উখিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত শিশু-কিশোরদের জন্য আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসহ বিভিন্ন এনজিওর উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করেছে। সরকার নির্ধারিত তিন হাজার একর বনভূমিতে সাড়ে ৪০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও মসজিদ-মাদ্রাসা রয়েছে তিন শতাধিক। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা, বার্মিজ ও ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সুবিধার ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম বলেন, ‘১২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৯৬টি মেডিক্যাল সেন্টারে স্থাপন করা হয়েছে। উখিয়ার ৪৮টি ও টেকনাফের ১২টি ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে চিকিৎসার পাশাপাশি ফ্রি ওষুধ বিতরণ করা হয়। নবজাতক ও অন্তঃসত্ত্বাদের স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি সব বয়সের রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে কলেরা প্রতিরোধে টিকা খাওয়ানোর কাজ সম্পন্ন করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে রোহিঙ্গারা ডিপথেরিয়া ও এইচআইভি ঝুঁকিতে রয়েছে।’ প্রতিদিন এইচআইভি এবং ডিপথেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে বলেও জানান তিনি।

সিভিল সার্জন আরও জানান, এখন পর্যন্ত ১১২ জন রোহিঙ্গা এইচআইভি পজিটিভ ও ৫০৮ জন ডিপথেরিয়া রোগী সনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। পাশাপাশি যক্ষা, হাম, পোলিও, কলেরা ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে রোহিঙ্গারা।

ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা জানান, তাদের কোনও ইনকাম সোর্স নেই। তাই ত্রাণের ওপর ভরসা করেই থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার, মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার দান থেকে প্রাপ্ত খাদ্য খেয়েই জীবন ধারণ করতে হচ্ছে। অসুখ হলে ওষুধ পর্যন্ত কেনার সামর্থ্য নেই তাদের। পুরোপুরি পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন তারা।

এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান বলেন, ‘ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। সরকারি ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও এসব ত্রাণ দিচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে চাল, ডাল ও তেলসহ সব ধরনের খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে।’ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার গত নভেম্বরে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এখন প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।

 

/এএইচ/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া