X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

দালাল নিয়ন্ত্রিত শ্রীপুরের ভূমি অফিস, ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না

রায়হানুল ইসলাম আকন্দ, গাজীপুর
২২ জানুয়ারি ২০১৮, ০৭:৪৭আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০১৮, ০২:৫৭

শ্রীপুর উপজেলা ভূমি অফিস কিছুদিন আগে নিজের ৮ শতাংশ জমির নামজারির জন্য শ্রীপুর পৌর ভূমি অফিসে যান আব্দুল ওয়াহাব নামের এক ব্যক্তি। দালালদের এড়িয়ে তিনি ওই অফিসের ভূমি কর্মকর্তার কাছে যান। কিন্তু আজিজুল হক (দালাল) নামের একজনকে দেখিয়ে ওই ভূমি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার কাছে তার মাধ্যমেই আসতে হবে।’
শুধু আব্দুল ওয়াহাবই নয়; ওই অফিসে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন শ্রীপুর পৌরসভার অনেক বাসিন্দাই। তারা জানান, শ্রীপুর পৌর ভূমি অফিসে দালাল ও ঘুষ ছাড়া কোনও কাজ হয় না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেবল শ্রীপুর পৌর ভূমি অফিস নয়; শ্রীপুর উপজেলা ভূমি কার্যালয় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়গুলোতেও একই চিত্র বিরাজ করছে।
গ্রাহকদের অভিযোগ, জমি নামজারির জন্য গেলে প্রতি নথিতে ‘অফিস খরচ’-এর কথা বলে ভূমি কর্মকর্তারা ঘুষ আদায় করে থাকেন। ঘুষ না দিলে কাজ তো হয়ই না; উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় ছাড়াও শ্রীপুরে ৭টি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব কার্যালয়ে জমির নামজারির আবেদন থেকে শুরু করে ডিসিআর (ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ) নেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে দালালদের মাধ্যমে ভূমি কর্মকর্তাদের টাকা দিতে হয়। এমনকি, পরামর্শ নিতে গেলেও টাকা দিতে হয়। পৌর ভূমি অফিসে কাজ করছেন আজিজুল হক নামে এক দালাল
গ্রাহক সেজে শ্রীপুর উপজেলা ভূমি কার্যালয় ও কয়েকটি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভূমি কর্মকর্তাদের মতো চেয়ার-টেবিল পেতে কাজ করছেন দালালরা। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি, অফিসের রেকর্ডপত্রও দালালদের হাতে। দালালদের এড়িয়ে ভূমি কর্মকর্তা পর্যন্ত যেতে পারেন না গ্রাহকরা। কোনও গ্রাহক দালাল এড়িয়ে ভূমি কর্মকর্তা পর্যন্ত পৌঁছে গেলে সেই ভূমি কর্মকর্তাই ওই গ্রাহককে দালালের হাতে তুলে দেন। এরপর দালালরা বিভিন্ন অজুহাত ও হয়রানির হুমকি দিয়ে ঘুষ আদায় করেন। দালালদের মাধ্যমে টাকা পেলেই দালালদের প্রস্তুত করা নথিতে ভূমি কর্মকর্তারা সই করেন। টাকা না পেলে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ভূমি কর্মকর্তারা নথি বাতিল করে দেন। ভূমি কর্মকর্তারা অফিস খরচের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে যে টাকা নেন তার একটা অংশ নথির সঙ্গে উপজেলা ভূমি অফিসের নামজারি সহকারীর কাছে দেওয়া হয়। টাকা না পেলে নামজারির নথি সহকারী কমিশনারের সামনে উপস্থাপনই করা হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক একর জমি নামজারি করতে ভূমি কর্মকর্তাদের ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। আর কাগজপত্রে সমস্যা থাকলে বা জমিতে গ্রাহকের দখল না থাকলে তা নামজারি করতে কয়েক লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। অথচ সরকারি বিধি অনুযায়ী ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ (ডিসিআর) করাতে এক হাজার একশ’ ৫০ টাকা লাগার কথা। বেশ কয়েক জন গ্রাহক জানান, কেবল নামজারি নয়; আরও নানাভাবে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকেন ভূমি কর্মকর্তারা।
শ্রীপুর পৌর ভূমি অফিস মাওনা উত্তরপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র সালেহা খাতুন জানান,পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সাড়ে তিন শতাংশ জমিতে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করে আসছেন তিনি। জমিটি তার দুই সন্তানের নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি শ্রীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে আবেদন করেন (নথি নং ৯৯০/১৬-১৭) তিনি। সহকারী কমিশনার (ভূমি) সালেহার নথি যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মাওনা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াহাবকে নির্দেশ দেন। পরে ওই ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা নূরে আলম প্রতিবেদন পাঠানো বাবদ সালেহার কাছে ৮ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। সালেহা ঘুষ না দেওয়ায় তার আবেদন বাতিলের প্রস্তাব করে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। ঘুষ না দেওয়ায় তার আবেদন বাতিল হয়ে যায়।
মাওনা গ্রামের আফাজউদ্দিন জানান, তিনি তার ১৫ শতাংশ জমি নামজারি করার জন্য আবেদন করেন। এসময় ভূমি অফিসে গেলে ভূমি কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াহাব অফিস খরচের কথা বলে ১১ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে ৮ হাজার টাকা দিলে নামজারির প্রস্তাব করেন।
মাওনা গ্রামের আবু নাছের অভিযোগ করেন, গফরগাঁওয়ের পাগলা এলাকার শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি শ্রীপুর উপজেলা ভূমি অফিসে দালালি করেন। তার কোটি টাকার জমি ভূমিদস্যুদের নামে নামজারি করিয়ে দিতে সহায়তা করেছিলেন শফিকুল। পরে শফিকুলের নামে থানায় অভিযোগ দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।
কেওয়া মৌজার ৭ শতাংশ জমি নামজারি করার জন্য মোহাম্মদ আলী নামে একজন তিন বার আবেদন করেছেন। একবার ভূমি অফিসের ভূমি কর্মকর্তার নিয়োগ করা দালাল আজিজুলকে ৩ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। দাবিকৃত আরও ৫ হাজার টাকার ব্যবস্থা করতে না পারায় আজও তার জমির নামজারি হয়নি।
একই মৌজার অন্য এক ভূমি মালিক জহুরা খাতুন অভিযোগ করেন, তার রেকর্ডের ২২ শতাংশ জমি অনেক টাকার বিনিময়ে অন্য একজনের নামে নামজারি করে দিয়েছেন ভূমি কর্মকর্তারা।
মাওনা ভূমি অফিসের উমেদার আবুল কাশেম বলেন, ‘আমরা কাজ করি ভূমি কর্মকর্তাদের অধীনে। তারাই আমাদের কাজের জন্য চেয়ার-টেবিল দিয়েছেন। তাদের হুকুমমতো বিভিন্ন কাজ করি। অন্য কাউকে জবাবদিহিতা করতে আমরা বাধ্য নই।’ মাওনা ভূমি অফিসে কাজ করছেন জাহাঙ্গীর নামে এক দালাল
শ্রীপুর পৌর ভূমি অফিসের উমেদার আজিজুল হক বলেন, ‘যে কোনও নথি ভূমি অফিসে এলে ভূমি কর্মকর্তার আদেশে অন্যান্য উমেদারদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এসময় নথিতে থাকা ভূমি মালিকদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে আমরা যোগাযোগ করি। পরে ভূমি মালিকরা এলে তাদের অফিস খরচ দিতে বলি। অফিস খরচ দিলে নথি তৈরির কাজ শুরু হয়।’
মাওনা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াহাব জানান, অফিসে লোকবল সংকটের কারণে বাইরের লোক দিয়ে কাজ করানো হয়। তবে নামজারি করতে কোনও টাকা লাগে না। খুশি হয়ে ভূমি মালিকরা যা দেয়, তাই তারা নেন।
শ্রীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সোহেল রানা জানান, কী কারণে এসব হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ভূমি অফিসে দালাল দিয়ে কাজ করার কোনও সুযোগ নেই। যদি শ্রীপুরের কোনও ভূমি অফিসে দালাল দিয়ে রেকর্ড করানো বা গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রে দালালদের হাত দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

/এমএ/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে