X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘরভাঙা ‘কালো’ রুবিনাই আজ সমাজের আলো

কামাল মৃধা, নাটোর
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৭:৫৯আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১০:১২

নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারে সফলভাবে প্রশিক্ষণ নেন রুবিনা শুধু গায়ের রঙ কালো বলেই সংসারে টিকতে পারেননি পিতৃহারা রুবিনা খাতুন। স্বামীর অবহেলা ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের অত্যাচারে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তার জীবন। মাত্র ৩৪ দিনেই ভেঙে যায় সংসার। বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে হয়। চারদিক থেকে আসা দুয়োধ্বনিতে বেঁচে থাকাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছিল তার। কিন্তু তবুও ভেঙে পরেননি রুবিনা। অদম্য ইচ্ছে নিয়ে লড়ে গেছেন। জীবনযুদ্ধের অবসাদগুলোকে শক্তিতে পরিণত করে স্ফিংসের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছেন তিনি। রুবিনা আজ যুদ্ধজয়ের অন্যতম আইকন। যে সমাজ একদিন তাকে ঠেলে দিয়েছিল হতাশার দুয়ারে, সেই সমাজই এখন তাকে বরণ করে নিয়েছে অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে।

সম্প্রতি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন থেকে দেওয়া কেআইবি কৃষি পদক ২০১৮ পেয়েছেন রুবিনা। কৃষিতে অবদান রাখায় নারী খামারি হিসেবে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন তিনি। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন বেশ কয়েকটি সম্মাননা। বাড়িয়েছেন সম্পদ। মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে গড়ে তোলা সংসারে এনেছেন সমৃদ্ধি। রুবিনার মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরেই একটি করে রুবিনা প্রয়োজন। রুবিনা যেকোনও মায়ের জন্যই অহংকার।’

নিজের পুকুরের মাছ হাতে রুবিনা নাটোরের একডালা চাঁদপুর গ্রামের তরুণী রুবিনা খাতুনের প্রসঙ্গে বলছিলাম। তার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলে জানা যায় জীবনের উত্থান-পতনের গল্প। ফেলে আসা অতীত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রুবিনা খাতুন বলেন, ‘মামার মাধ্যমে পরিচয় হয় সৌদি প্রবাসী তরুণ হুমায়ুনের সঙ্গে। ২০১১ সালে ওই ছেলের পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তুাব পাঠানো হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৯ এপ্রিল মোবাইলের মাধ্যমে বিয়ে হয় আমাদের। কিছুদিন পর হুমায়ুন দেশে ফিরে আসে। সে বছরের ১২ জুলাই শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শুরু হয় আমার সংসার। মাত্র ৩৪ দিনের সংসার। তারপরই আবারও সৌদি চলে যায় হুমায়ুন। এরপরই শুরু হয় শাশুড়ি ও ননদের মানসিক অত্যাচার। আমার বিরুদ্ধে তাদের একটাই অভিযোগ, আমার গায়ের রঙ কালো।’

রুবিনা জানান, তিনি সবসময় শাশুড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সবার মন জুগিয়েই চলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাকে সবসময় অবজ্ঞা করা হয়েছে। উদাহরণ টেনে রুবিনা বলেন, “ছোটবেলা থেকেই বাড়ির নলকূপে গোসল করার অভ্যাস আমার। কোনোদিন পুকুরে গোসল করিনি। এটা নিয়ে প্রায়ই শাশুড়ি ও ননদ বকাবকি করত। একদিন ননদ আমাকে জোর করে পুকুরে নামিয়ে দেয়। সাঁতার না জানায় পুকুরের ঘোলা পানিতে আমার ডুবে মরার দশা। কোনোক্রমে জীবন নিয়ে পাড়ে উঠে আসি। পরে ননদ আমাকে বলে, ‘মনে করেছিলাম পানিতে ডুবিয়ে মারব, তাও করতে দিলি না?”

নারী কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে রুবিনা পেয়েছেন কেআইবি কৃষি পদক শাশুড়ি ও ননদের অত্যাচার মাত্রা ছাড়ালে একদিন স্বামীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন রুবিনা। স্বামী তাকে বাবার বাড়ি চলে যেতে বলে। স্বামীর কথায় বাড়ি ফিরেও আসে রুবিনা। মাস চারেক পর ১৬ ডিসেম্বর তিনি ডিভোর্স লেটার পান।

গ্রামের মেয়ে রুবিনার তখন চোখে-মুখে অন্ধকার। একদিকে সংসার ভেঙে যাওয়ার বেদনা, অন্যদিকে রক্ষণশীল সমাজের দুয়োধ্বনি, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ—সব মিলিয়ে রুবিনার সম্বল তখন কেবলই অশ্রু। ঘরে বৃদ্ধা মা রোকেয়া রহমান, ছোট ভাই রুবেল আর ছোট বোন রোখসানাও তখন ওই পরিস্থিতিতে অথৈ সাগরে। এই চাপ সামলে ওঠা কি সমাজের প্রান্তিক এক তরুণীর পক্ষে সম্ভব?

প্রশ্নের জবাব দিলেন রুবিনা নিজেই। বললেন, ‘মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করব। বেঁচে থাকার কোনও শক্তিই যেন অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু মা আর ছোট ভাইবোনের দিকে তাকাতেই মনে হয়, আমি না থাকলে ওদের কে বাঁচাবে? মা আর ভাইয়ের চোখের জল আমাকে আত্মহত্যার চিন্তা থেকে সরে আসতে বাধ্য করে।’

রুবিনা তখন ভাবেন, গায়ের রঙ কালো বলে সংসার ভাঙলেও কালো মানুষের কর্ম করতে তো কোনও সমস্যা নেই। কাজ দিয়েই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন। সেলাইয়ের কাজ জানতেন আগে থেকেই। শুরুটাও করেন সেই কাজ দিয়েই। শুরুতে সবার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে একত্রিত করতে থাকেন নির্যাতিত নারীদের। গড়ে তোলেন সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

রুবিনার পেপের বাগান কিছুদিন পরই একটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন ব্রয়লার মুরগির খামার। ভাগ্য খুলতে শুরু করে তার। ২০১৫ সালে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দুই লাখ টাকা পুরস্কার পান। ওই টাকাও বিনিয়োগ করেন। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রুবিনাকে। তখন থেকেই সম্প্রসারিত হতে থাকে তার খামার।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন কৃষি খামার। বাবার রেখে যাওয়া ১০-১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন কুল, আম ও পেয়ারা বাগান। বাড়ির পাশের পুকুরে শুরু করেন মাছের চাষ। ওই পুকুরেই শুরু করেন সমন্বিত পদ্ধতিতে হাঁস চাষ। শুরুতে দেড় বিঘা জমিতে ফলের বাগান করলেও এখন আরও সাড়ে ৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ফলের চাষ করছেন রুবিনা।

এখানেই শেষ নয়, বাড়ির আঙিনায় দেড়শ কবুতর পালন করছেন রুবিনা। এর বাইরেও রয়েছে ৭৬টি লাভ বার্ড আর এক হাজার কোয়েল পাখি।

নিজের সংসার ভাঙলেও ছোট ভাই রুবেলকে বিয়ে দিয়েছেন রুবিনা। তার একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। আর ছোট বোন রোখসানা রহমান পদার্থবিজ্ঞানে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। মা রোকেয়া বেগমের প্রতিদিনের ওষুধ আর বোনের পড়ার খরচসহ সংসারের সব খরচ বাদ দিয়েও বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় করছেন বলে জানান রুবিনা।

রুবিনার মুরগির খামার নিজেকে একসময় যে অসহায় পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, তেমন পরিস্থিতিতে যেন নারীদের না পড়তে হয়, তার জন্য এখন কাজ করছেন রুবিনা। নির্যাতিত নারীদের সেলাই মেশিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে জীবনের বাঁক বদলের গল্প লেখা রুবিনা এখন ফল চাষের প্রশিক্ষণও দেন নারীদের। নিজে নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারে বছরব্যাপী ‘ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেই প্রশিক্ষণ এখন ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্যদের মধ্যে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেককে ৮-১০টি করে বিভিন্ন ফলের গাছও দেন তিনি। এছাড়া আইএফএমসি স্কুল পরিচালনা করে রুবিনা অবহেলিত নারীদের গরু, হাঁস, মুরগি পালনের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন।

রুবিনা বলেন, ‘ইয়ুথ উইমেন্স ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি থেকে নিবন্ধন নিয়েছি। মহিলা বিষয়ক অধিদফতর থেকেও সহায়তা পাচ্ছি। সমবায় সমিতির মাধ্যমে এখন একটি প্রকল্পের কাজ করছি। গ্রামের অবহেলিত নারীদের জন্য এই প্রকল্প থেকে একশটি পরিবারকে দুইশটি গাভী কিনে দেওয়া হবে। প্রতিটি নারীকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা করে ঋণ দিয়ে এই গাভী কিনে দেবো। এক বছর পর গাভীগুলোর বাছুর হলে দুধ বিক্রি করে তারা ৩৬ কিস্তিতে ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন।’ পরিবারের বয়োবৃদ্ধ অবহেলিতদের জন্য নাটোরে একটি বৃদ্ধাশ্রম করবেন বলেও ইচ্ছে আছে তার।

নিজে কালো বলে সংসার ভেঙেছে, নিগৃহের শিকার হয়েছেন। তাই রুবিনা চান না, সমাজের আর কোনও মেয়ে এমন নিগৃহের শিকার হোক। রুবিনা বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হওয়ার তা হয়েছে। সংসার হারিয়েছি, কটুকথা শুনেছি। বেঁচে থাকতে পারবো, সেই বিশ্বাসটুকুও ছিল না। আমি চাই না, গায়ের রঙ কালো বলে কিংবা অন্য কোনও তুচ্ছ কারণে আর কোনও মেয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হোক। তাই বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত মেয়েদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে আমি আজীবন কাজ করে যেতে চাই।’

আরও পড়ুন:
সুনামগঞ্জে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ

/এএইচ/টিআর/আপ-এসএনএইচ/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি