X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাঁঠালবাড়ি ঘাটে ফেরিতে উঠতে বিভিন্ন স্পটে দিতে হয় চাঁদা

জহিরুল ইসলাম খান, মাদারীপুর
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৭:৫২আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৫:২৭

কাঁঠালবাড়ি ঘাটে ফেরিতে উঠতে বিভিন্ন স্পটে দিতে হয় চাঁদা পদ্মায় তীব্র স্রোত, চর-ডুবোচর, ফেরি নষ্ট, ঈদের আগে ও পরে যানবাহনের চাপ এবং শীতে কুয়াশার কারণে দীর্ঘ সময় ফেরি চলাচল বন্ধসহ বিভিন্ন বৈরী পরিস্থিতিতে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌ-রুটে বেড়েছে চাঁদাবাজির হার। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুরের ‘ভাঙ্গার মোড়’ থেকে শুরু করে কাঁঠালবাড়ি ঘাট পর্যন্ত ফেরিতে উঠতে বিভিন্ন স্পটে দিতে হয় চাঁদা। পুলিশ ও ঘাটের নিয়ন্ত্রক প্রভাবশালী চাঁদাবাজদের কারণে পাঁচ্চর বাজার থেকে ফেরির পন্টুন পর্যন্ত মাত্র ২ কিলোমিটারের মধ্যেই তিন থেকে চারবার চাঁদাবাজির শিকার হন ট্রাকচালকরা। এছাড়াও ঈদ ও বৈরী আবহাওয়ায় ফেরি চলাচলে সমস্যা থাকলে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ ছোট যানবাহনে পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়।
সরেজমিন কাঁঠালবাড়ি ঘাট
স্থানীয় একাধিক সূত্র ও ভুক্তভোগী ট্রাকচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘন কুয়াশার কারণে দুই মাস ধরে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এই অবস্থায় কাঁঠালবাড়ি ঘাটে পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়। বৃহত্তর ফরিদপুরসহ খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং ২১ জেলা থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ভাঙ্গা-বিশ্বরোড মোড়ে পৌঁছানোর পর কাঁঠালবাড়ি রোডে ঢুকতে ট্রাকপ্রতি হাইওয়ে পুলিশকে ২০০ টাকার বেশি করে চাঁদা দিতে হয়েছে। পাঁচ্চর বাজারে ওজন স্কেলের কাছে দ্বিতীয় দফা চাঁদা, প্রধান সড়ক থেকে বাংলাবাজার-শিকদারকান্দি মোড় পার হয়ে বাইপাসে ঢোকার পর পুলিশের সার্জেন্টের সিরিয়ালের নামে তৃতীয় দফা এবং ঘাটে ফেরিতে ওঠার সময় মালিক সমিতির নামে স্থানীয় চাঁদাবাজদের চতুর্থ দফা চাঁদা দিতে হয়। প্রত্যেক ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা করে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে মোট দেড় থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে স্থানীয় পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকা চাঁদাবাজরা।
ট্রাকচালকদের চরম দুর্ভোগ ও অভিযোগ
বরিশাল থেকে মালামাল বোঝাই করে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে এসেছেন মাদারীপুরের ট্রাকচালক আবুল কালাম। গন্তব্য রাজধানী ঢাকা। ঘাটে এসে আটকে গেছেন। এর আগে তিন জায়গায় চাঁদা দিয়ে এসেছেন। ঘাটে এসে তার ট্রাক রাখা হয়েছে ট্রাক টার্মিনালে। এখানে ঢোকানোর পর পুলিশকে টাকা না দেওয়ায় একদিনের বেশি সময় ধরে আটকে আছেন। অথচ টাকা দিয়ে পরে আসা অনেকেই ঘাট পার হয়ে গেছেন।
মাদারীপুরের ট্রাকচালক আবুল কালাম বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে ট্রাকটি কিনেছি। ঘাটে পুলিশকে টাকা না দেওয়ায় সিরিয়াল পাওয়া যাবে না। কুয়াশায় ফেরি বন্ধ ছিল। পুলিশকে ৫০০ টাকা দিতে চাইলেও তারা নেয়নি। আরও বেশি দাবি করে। এই টাকা দিলেও ফেরিতে উঠতে পারবো না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা করে ফেরিতে ওঠার সময় স্থানীয় চাঁদাবাজরা। তাদের ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা না দিলে মারধরও করে।’
যশোর থেকে কাঁচামাল বোঝাই করে ঘাটে এসেছেন ট্রাকচালক জামাল মাতুব্বর। তিনি বলেন, ‘ফরিদপুরের ভাঙ্গার মোড়ে আসার পর হাইওয়ে পুলিশ প্রতি গাড়িতে ২০০ টাকা করে নিয়েছে। মালিগ্রামের কাছে পুলিশ নিয়েছে ১০০ টাকা। এরপর পাঁচ্চর ওজন স্কেলের কাছে ৫০০ টাকা নিয়েছে। এরপর বাইপাস কাঁঠালবাড়ি ঘাটে সার্জেন্টের চাঁদা গাড়িপ্রতি ২০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। যারা একদিন আগে এসেছে তাদেরও ছেড়ে দিচ্ছে না। অথচ শাকসবজি নিয়ে তিন রাত ধরে বসে আছি একই স্থানে। এখানে পুলিশের দুর্নীতির কোনও শেষ নেই।’
খুলনা থেকে একটি ট্রান্সপোর্টের মালামাল নিয়ে এসেছেন ট্রাকচালক সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তিনদিন ধরে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে আটকে রেখেছে। ভাঙ্গা এলাকায় সিরিয়ালে হাইওয়ে পুলিশকে ১০০ টাকা দিতে হয়েছে। পাঁচ্চর ওজন স্কেলের টাকা দেওয়ার পর রিসিট পুলিশ তাদের কাছে নিয়ে রাখে। তাদের ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা না দিলে রিসিট দেয় না। এই রিসিট ছাড়া ফেরিতে ওঠা যায় না। এরপর ঘাটে ঢুকতে ‘সার্জেন্টের চাঁদা’ নামে ১০০ টাকা দিতে হয়। ফেরিতে উঠতে স্থানীয় চাঁদাবাজদের দিতে হবে আরও ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। এই টাকা না দিলে মালিক সমিতির নামে স্থানীয় চাঁদাবাজরা ট্রাক ড্রাইভারদের মারধর করে। এখানে চাঁদার টাকা ছাড়া কোনও নিয়ম-কানুন নাই।’
বরিশাল থেকে ঢাকাগামী ট্রাকচালক সাইফুদ্দিন বলেন, ‘এত জায়গায় চাঁদা দেওয়ার বিষয়টি প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তারাও চোখে দেখছেন না! চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করলে আমরা শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হই।’
পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিসি’র পাল্টাপাল্টি দায় অস্বীকার
কাঁঠালবাড়ি ঘাটের কাছে বাইপাস মোড়ে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের দাবি, তারা শুধু শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। বিআইডব্লিউটিসি’র ঘাট কর্মকর্তারা যখন যতটি গাড়ি চান তারা তখন ততটি গাড়ি ছেড়ে দেন। কোনও ধরনের চাঁদা আদায় করা হয় না।
কাঁঠালবাড়ি ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিআইডব্লিউটিসি’র ব্যবস্থাপক সালাম হোসেন বলেন, ‘সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ প্রশাসন। আমরা যে ফেরিতে যতটি গাড়ি দরকার পুলিশকে জানাই। পুলিশ এখানে পাঠিয়ে দেয়, আমরা তা ফেরিতে লোড করি এবং পারাপার করি।’
হাইওয়ে পুলিশ ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (মাদারীপুর অঞ্চল) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমি এখানে নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। যদি মহাসড়কের হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকে তাহলে সেই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘স্থানীয় থানা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে ঘাটের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিশেষ সুবিধা নিয়ে কিছু কিছু ট্রাককে আগে পার করা হচ্ছে এমন অভিযোগ পেলে আমরা সেখানে গিয়ে ব্যবস্থা নেই। এখানকার হাইওয়ে পুলিশের দুর্নীতির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদারক করেন। তবে হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা পুলিশের মধ্যে সমন্বয় করেই আমরা ব্যবস্থা নেই। দীর্ঘদিন ধরে ঘাটে একটি প্রভাবশালী চক্রের প্রভাব ছিল তা সবাই জানে। তবে রাস্তার কোথাও গাড়ি থামিয়ে কেউ চাঁদা আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মহাক্ষমতাবান প্রভাবশালী চক্র
সরেজমিনে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটের বিকল্প হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকে এই নৌ-রুটে চালু হয় ফেরি সার্ভিস। বিআইডব্লিউটিসি’র জনবল কম থাকায় ফেরিতে গাড়ি উঠতে সহযোগিতার নামে আস্তে আস্তে ঘাটের দখল নেয় স্থানীয় প্রভাবশালীরা। বর্তমানে ফেরি, লঞ্চ, স্পিডবোট, ট্রলার, বাস ও মাইক্রোবাস এবং ঘাটের দোকানপাট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও সড়কে যানবাহনের সিরিয়ালসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের দেড়শতাধিক কর্মী প্রতিদিন ঘাটের বিভিন্ন স্তর থেকে চাঁদা আদায় করে। ট্রাক থেকে চাঁদা আদায়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্ন স্পটে ১৫ থেকে ২০ জন কর্মী। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা।
সরেজমিনে আরও জানা গেছে, বৈরী পরিস্থিতিতে ঘাটে যানজট সৃষ্টি হলে খুশি হয় চাঁদা আদায়ের সঙ্গে জড়িতরা। এ সময় বাড়ে চাঁদার মাত্রা ও খাত। এখানকার সরকার দলীয় প্রভাবশালী এক নেতার নিয়ন্ত্রণে চাঁদাবাজরা কখনও কৌশলে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করে অব্যবস্থাপনা। এ সময় সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। এই চাঁদাবাজদের গডফাদারের নাম প্রকাশ্যে কেউ বলতে সাহস পায় না। তবে বিষয়টি সবাই জানেন।
স্থানীয় একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটটি মাদারীপুর-১ (শিবচর) সংসদীয় আসনের মধ্যে। এখানকার জনপ্রতিনিধি আওয়ামী লীগ নেতা নূর-ই-আলম চৌধুরী (লিটন)। আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত শিবচরে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরাই এই ঘাটটি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই দীর্ঘদিনেও এখানে নৌ-পথে চলাচলকারী লঞ্চ-স্পিডবোট ও ট্রলার, এমনকি সড়কপথে বাস-মাইক্রোবাস ও ফেরিঘাটের যাবতীয় অনিয়ম দূর করতে পারেনি প্রশাসন।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে চাঁদাবাজদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। র‌্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে জেলা প্রশাসন চাঁদাবাজদের ধরতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও অজ্ঞাত কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। মাদারীপুর জেলা থেকে ঘাট প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় এখানে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কম। ঘাট এলাকা ও মহাসড়কে কৃত্রিম বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও পুলিশ মিলে চাঁদাবাজি করে থাকে। অনেক সময় কৌশলে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়, যে কারণে জেলা পুলিশ চাইলে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘অভিযোগ থাকায় এরই মধ্যে মাদারীপুরের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) উত্তম কুমার শর্মাকে বদলি করা হয়েছে। এছাড়া কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে এসব বিষয়ে পুলিশকে সতর্ক থাকার কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

/বিএল/টিএন/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কুড়িয়ে পাওয়া সাড়ে চার লাখ টাকা ফিরিয়ে দিলেন ইজিবাইকচালক
কুড়িয়ে পাওয়া সাড়ে চার লাখ টাকা ফিরিয়ে দিলেন ইজিবাইকচালক
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং দ্বৈরথ
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং দ্বৈরথ
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি