দেশ-বিদেশের পর্যটক ও আগ্রহী মানুষ প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণের স্মৃতিবিজড়িত স্থান মেহেরপুরের মুজিবনগর পরিদর্শনে আসেন। তাই আন্তর্জাতিক মানের ‘মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র’ নির্মাণে বিশাল কর্মযজ্ঞের ‘মুজিবনগর প্রকল্প’ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা সত্ত্বেও নানান জটিলতা এবং মাঝখানে সরকার পরিবর্তন হওয়ায় সে প্রকল্পের কাজ আর আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। তাই ৬শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘মুজিবনগর প্রকল্পে’র মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকেন্দ্রের ভাস্কর্য আবার পরিবর্তন করা হবে। এজন্য এবার ৩শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সাদা সিমেন্টের ভাস্কর্য সরিয়ে সেখানে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য করা হবে বলে গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। মেহেরপুর-১ আসনের এমপি ফরহাদ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার তৎকালীন বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথগ্রহণ করেছিল। স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ এই আম্রকাননকে সংরক্ষণসহ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে রূপান্তরিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ৩১ আগস্ট লিখিত নির্দেশ দেন। এরপরই গণপূর্ত অধিদফতর ঐতিহাসিক স্থানটিতে জাদুঘর, স্মৃতিসৌধ এবং অতিথি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে এসে ওই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সবকিছু উলট-পালট করে দেয়। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে আবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালে ১ কোটি ৯৩ লাখ ১১ হাজার ১৩৩ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে স্মৃতিসৌধ এলাকায় ৬৬ একর জমির ওপর ১১টি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতর ও অধিদফতর মুজিবনগর কমপ্লেক্স স্থাপনের কাজ শুরু করে। এই প্রকল্পের প্রাথমিক কাজে মেহেরপুরের সাবেক এমপি ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান, বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবং মেহেরপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক শামসুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৫৬৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকার প্রকল্পের মধ্যে ৪৫ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকায় ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানচিত্র’ প্রকল্পটি ২০০৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আজও তা শেষ হয়নি। কাজের মাঝপথে সংশোধনী আনার পাশাপাশি কাজ শেষের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০১০ সাল। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পে কিছু কাটাছেঁড়া, সংযোজন-বিয়োজন করে দ্বিতীয় সংশোধনীতে ৪৭ কোটি ৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকার বাজেট নির্ধারণ করা হয় এবং কাজ শেষ করা হয় ২০১১ সালে।
মুজিবনগর প্রকল্পে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ শেষ হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়নি। এরইমধ্যে অনেক ভাস্কর্যের কোনোটি বিবর্ণ, কোনোটি ভেঙে পড়েছে। কোনোটিতে দেখা দিয়েছে ফাটল। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভাস্কর্যে বঙ্গবন্ধুকে দৃশ্যমান করতে পারেনি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভাস্কর্যের ভেঙে যাওয়া আঙুল, নিরীহ বাঙালির বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ভাস্কর্যে পাকিস্তানি সেনার ভেঙে পড়া হাতসহ বিভিন্ন ভাস্কর্য মেরামত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ সময় পার হলেও মুজিবনগর কমপ্লেক্সের কাজে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অবহেলায় দিন দিন মুজিবনগর তার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। পরিচর্যার অভাবে মারা যাচ্ছে আম্রকাননের আম গাছ। বিলীন হয়ে যাচ্ছে কমপ্লেক্সের ভেতরে তৈরি করা ছয় দফা আন্দোলনের প্রতীক ৬টি গোলাপ উদ্যানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ফলে মুজিবনগর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা।
ভাস্কর্য নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এমএম বিল্ডার্সের ভাস্কর্য প্রকল্পের প্রধান ভাস্কর গোপাল চন্দ্র পাল জানান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এসব ভাস্কর্য নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় যেমনটি চেয়েছেন তেমনভাবেই ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের তৈরি মুজিবনগরে ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ মানচিত্র প্রকল্পে স্থাপিত ভাস্কর্য সবই আন্তর্জাতিক মানের। শত বছরেও এই ভাস্কর্য নষ্ট হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশি রড, সিমেন্ট দিয়ে এসব ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে।’ অনেক ভাস্কর্য ভেঙে পড়ছে কেন- প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যত্ন না নেওয়ার কারণেই ভেঙে পড়তে পারে।’
এমএম বিল্ডার্সের কনসালটেন্ট টিম লিডার মজিবর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, প্রকল্প গ্রহণের সময় পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক মানের ভাস্কর্য নির্মাণের। তাদের সে পরামর্শ নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাদের পরামর্শ না শুনে তড়িঘড়ি করে কাজ করানো হয়েছে।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফাইবার গ্লাস মিডিয়া দিয়ে এসব ভাস্কর্য করা হয়েছে। ভাস্কর্যগুলো লং লাস্টিং নয় এবং এই ভাস্কর্যগুলো আন্তর্জাতিক মানে গড়া হয়নি। আর কয়েক বছরের মধ্যে সব ভাস্কর্য সৌন্দর্য হারাবে।’
স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন জানান, ‘সাদা সিমেন্টে তৈরি ভাস্কর্যগুলো সরিয়ে সেখানে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে। এ জন্য ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।’
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোক্তার হোসেন দেওয়ান জানান, নতুন করে ২৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রেস্ট হাউজ, লেকব্রিজ, শিশুপার্কসহ বিভিন্ন স্থাপনা করা হবে।’