‘আকাশেতে লক্ষ তারা ঝিকিমিকি হাসে, গতরাতে স্বপ্নে দেখি বিউটি আমার পাশে’। একটি কাঁথার মধ্যে সাদা এক টুকরো কাপড়ে সেলাই করে লেখা হয়েছে কথাগুলো। নিচে লেখা, ‘মো. আলম’। পাশেই আরেক টুকরো সাদা কাপড়ে সেলাই করে যুক্ত করা হয়েছে এক নারীর ছবি। পরিচয়ে বলা হয়েছে, ‘নিখোঁজ বিউটি বেগম (৩০)’। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিখোঁজ হন ওই ভবনের একটি গার্মেন্টের শ্রমিক বিউটি। তাকে স্মরণ করে কাঁথাটি সেলাই করেছে মেয়ে ফারজানা।
আরেকটি কাঁথায় যুক্ত এক কিশোরের ছবির ওপরে লেখা, ‘এমডি রাব্বী স্মরণে, নিহত ২৪ এপ্রিল, রানা প্লাজা ধসে।’ নিচে লেখা, ‘দুঃখীনি মা রাহেলা’।
এরকম আরও কয়েকটি কাঁথা ও রুমালে এভাবে মনের আকুতি জানিয়ে ওই দুর্ঘটনায় নিহত-নিখোঁজদের স্মরণ করেছেন তাদের স্বজনরা। পাঁচ বছর পরও ভবন ধসে স্বজন হারানোর ওই ঘটনা কতখানি দগদগে ঘা হয়ে আছে তাদের মনে, কাঁথার ফোঁড়ে তা জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে।
সাভারে রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছর উপলক্ষে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে ‘স্মৃতির কাঁথা ও কথা’ নামের এক প্রদর্শনীতে কাঁথাগুলো তুলে ধরা হয়। শুক্রবার (২০ এপ্রিল) বিকালে ধসে পড়া ওই ভবনের স্থানটির সামনে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির উদ্যোগে ‘মৃতদের স্মরণ করো, জীবিতদের জন্য লড়াই করো’ এই স্লোগানে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
প্রদর্শনীতে স্মৃতি কাঁথাগুলো রানা প্লাজার ১৫ নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিক পরিবারের নারী সদস্যদের সেলাই করে তৈরি করা। কেউ কেউ নিজেদের মনের কথা লিখে তৈরি করেছেন বিভিন্ন কারুকাজের ছোট রুমাল। অনেকেই রুমালে নিহত শ্রমিকের ছবি সংযুক্ত করে নিচে লিখেছেন, ‘২৪ এপ্রিল অমর হোক’। এভাবেই নিজের প্রিয় মানুষের স্মৃতি স্মরণ করে সুঁই সুতায় এসব কাঁথা সেলাই করে তৈরি করেছেন নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনেরা।
রানা প্লাজায় নিহত পলি আক্তারের মা শাহানা ও আঁখির মা নাছিমা বলেন, মেয়ে হারানোর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও সন্তান হারানোর বেদনা ভুলতে পারেননি তারা। তাই সন্তানের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তারা কাঁথা সেলাইয়ের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন।
প্রদর্শনী চলাকালে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভা প্রধান তাসলিমা আক্তার, সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুর ইসলাম শামা, দফতর সম্পাদক মুসা সলিমুল্লাহ ও কয়েকজন নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবারের সদস্য বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ধসের ঘটনা ঘটেছে সাভারের রানা প্লাজায়। ভবন ধসের ৫ বছর হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এ ঘটনার জন্য দায়ী ভবন মালিক সোহেল রানার শাস্তি হয়নি। এ কারণে তারা স্মৃতি কাঁথা প্রদর্শনীর মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের আইন বদল এবং এ ধরনের ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয়, সে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছেন।
বক্তারা আরও বলেন, রানা প্লাজার কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডে এক হাজার ১৭৫ জনেরও বেশি শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। অথচ ৫ বছর হয়ে গেলেও সেই বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিচার কাজ এখনও শেষ হয়নি। শ্রমিক নেতারা বলেন, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে যে শ্রমিকরা, তারাই আজ সবচেয়ে অবহেলিত। বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকায় বেতনে বেঁচে থাকা দায়। তাই শ্রমিকদের মজুরি ১৬ হাজার টাকা করার দাবি জানান তারা।