X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পানি সংকটে ধুঁকছে তিস্তা, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

মোয়াজ্জেম হোসেন, লালমনিরহাট
২৩ এপ্রিল ২০১৮, ০৮:০০আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০১৮, ১৮:২৪





তিস্তা নদী
উজানে ভারতের অংশে অপরিমিতভাবে পানি প্রত্যাহার করায় ভাটিতে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে গেছে। আন্তর্জাতিক এ নদীটির বাংলাদেশ অংশের বেশিরভাগে পড়েছে চর। পানির অভাবে সেচ প্রকল্প ব্যাহত হচ্ছে। এতে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা যেমন দেখা দিয়েছে, তেমনি স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ না থাকায় হুমকির মুখে পড়েছে তিস্তা অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও নদী বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার এলাকার গজলডোবায় তিস্তা নদীতে সেচ প্রকল্প ব্যারাজ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ অংশের লালমনিরহাটে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

নদী গবেষকদের আশঙ্কা, তিস্তা পানি চুক্তি না হলে এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে তিস্তার প্রবেশপথ লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম। প্রবেশপথ থেকে হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ পর্যন্ত নদীতে পানিপ্রবাহ প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ কিউসেক থাকলেও তিস্তা ব্যারাজের ভাটি থেকে লালমনিরহাট-রংপুরের কাউনিয়া এলাকা পর্যন্ত পানিপ্রবাহ ৩০০ থেকে ৪০০ কিউসেক।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দহগ্রাম থেকে তিস্তা ব্যারাজ পর্যন্ত নদীতে পানি না থাকায় স্থানীয় কৃষকেরা তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে ভুট্টা ও মিষ্টি কুমড়ার চাষ করেছেন। সেচ প্রকল্পের জন্য পানি সরবরাহ করার কারণে হাতীবান্ধায় তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে পানি সংকট আরও তীব্র। তিস্তা ব্যারাজ থেকে লালমনিরহাট-কাউনিয়া এলাকা পর্যন্ত নদীতে পানি ঠেকেছে তলানিতে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীটির বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটারই কমবেশি পানি সংকটে ধুঁকছে।

তিস্তার বুকে বালুচর বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৩ সালে ভারত-বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীর পানিবণ্টনে সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় বলা হয়, তিস্তার পানি শতকরা ভারত ৩৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ পাবে। অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ পানি নদীতে সংরক্ষণ করা হবে। কিন্তু কীভাবে এই পানি ভাগাভাগি করা হবে, সে বিষয়ে কোনও দিকনির্দেশনা ছিল না। কিন্তু সে সিদ্ধান্তও আলোর মুখ দেখেনি। পরে ২০০৭ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে তিস্তার ৮০ শতাংশ পানি সমান অংশে ভাগ করে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ পানি তিস্তা নদীর গতিধারা ঠিক রাখতে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে অসম্মতি জানান এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির আলোচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।ফলে দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি ঝুলে থাকায় বাংলাদেশ অংশে ন্যায্য পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

লালমনিরহাটের কাকিনা-মহিপুর দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু এলাকার বাসিন্দা মোতাবেল হোসেন ও তার প্রতিবেশীদের ভিটামাটি ও জায়গাজমি কয়েক দফায় তিস্তা নদীর প্রবল বন্যায় বিলীন হয়ে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় জেগে ওঠা চরে তারা রসুন, মিষ্টি কুমড়া ও ভুট্টা চাষ করেছেন।

মোতালেব হোসেন বলেন, ‘যদি তিস্তায় পানি না থাকে তাহলে কিছুই হওয়ার নয়। এখনই খুব খারাপ অবস্থা। এখন পানি না থাকায় চরের সব জিনিস মরে যাচ্ছে, নদীতে মাছও নেই।’ পানি চুক্তি হলে দুই দেশের লাভ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান বলেন, ‘প্রতিবছর বর্ষাকালে ভারতের ছেড়ে দেওয়া পানিতে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে স্থানীয় লোকজন। হাতীবান্ধা উপজেলার দুঃখই বর্ষাকালে তিস্তা নদীর পানি। অথচ এখন শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি নেই।’ তিনি জানান, জেলেরা পেশা বদল করে ফেলছে। সেচ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানি নেই, নদীর অস্তিত্ব রক্ষার মতো পানিটুকুও তিস্তায় নেই।
পানির সংকটে তিস্তার আশপাশের জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে এবং জীববৈচিত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে আতিয়ার রহমান বলেন,‘তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি এবং বাস্তবায়নে ভারত-বাংলাদেশ সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে উভয় দেশের জনগণ মনে করে। আমিও তাই মনে করি।’

নদীর পানি কমে যাওয়ায় সহজে গাড়ি পারাপার হচ্ছে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউর বারী বলেন, ‘‘১১টি উপজেলার ৭৯ হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প-১ পর্যায়ের ক্যানেল নির্মাণ করা হলেও পানিপ্রবাহ না থাকায় সেচ সুবিধা থেকে কৃষকেরা বঞ্চিত রয়েছে। মাত্র পাঁচ উপজেলার ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। পানি সংকটের কারণে তা-ও নিয়মিত পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন,‘গত পাঁচ বছরে ৫০০ কিউসেকের বেশি পানি সেচ প্রকল্পে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তিস্তার বুকে পলি পড়ে নাব্য সংকটের কারণে পানি ধারণ ক্ষমতাও কমে গেছে। দ্রুত তিস্তা চুক্তির মাধ্যমে পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে নদীটি যেমন প্রাণ ফিরে পাবে তেমনি সেচ প্রকল্পের পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।’

তিস্তা ব্যারাজ (ডালিয়া) পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘সেচ প্রকল্প এলাকায় পানি সরবরাহ এবং তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ২০ হাজার কিউসেকের বেশি পানিপ্রবাহ থাকা প্রয়োজন। শুধু নদীর অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্যই প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি, সেখানে গড়ে দেড় হাজার কিউসেকে বেশি পানিপ্রবাহ পাওয়া যায় না।’ এতে নদী বাঁচবে কীভাবে আর সেচ কার্যক্রমই বা চলবে কীভাবে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘এ কারণে কৃষি জমিতে সেচের জন্য প্রকল্প এলাকায় প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
রফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবছরই সেচ প্রকল্প এলাকায় সেচের আওতা কমানো হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছর পর তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে এক ফোটাও পানি থাকবে না। সেক্ষেত্রে সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’ তাই এখনই উচিত তিস্তাকে বাঁচাতে পানিবণ্টন চুক্তি করা এবং তা বাস্তবায়ন করা বলে মন্তব্য করেন তিনি।

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী