X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডায়েরি পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে নর্থবেঙ্গল সুগারমিলের প্রশাসক আজীমকে

কামাল মৃধা, নাটোর
২৩ এপ্রিল ২০১৮, ১১:৩০আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:৩৪

শহীদ লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজীম মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছিলেন নাটোরের নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের প্রশাসক লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজীম। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করতেন তিনি। আর সেই হিসাব তিনি লিখে রাখতেন ব্যক্তিগত ডায়েরিতে। নর্থবেঙ্গল সুগার মিলে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করার পর সেই ডায়েরি পড়ে তাদের হাতে। পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে আনোয়ারুল আজীম মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করবেন— এই বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি তারা। আর সে কারণেই অন্যদের সঙ্গে তাদের হাতে প্রাণ হারাতে হয় তাকে।

মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন আনোয়ারুল আজীম। জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে তাকে ভূষিত করেছে সরকার। দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় এই স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি তার পরিবারের সদস্যরা। স্থানীয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরাও আনন্দিত এই খবরে।

জানা যায়, লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজীমের কর্মস্থল নর্থবেঙ্গল সুগারমিল হলেও তার বাড়ি ছিল নওগাঁ জেলায়। তার পরিবারে স্ত্রী ছাড়াও দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আজীমের স্ত্রী শামসুন্নাহার আজীম মৃত্যুবরণ করেন। একমাত্র মেয়ে নাজমা বখতিয়ার ও বড় ছেলে আনোয়ারুল কবির কানাডা প্রবাসী। ছোট ছেলে ডা. আনোয়ারুল ইকবাল ঢাকায় থাইরোকেয়ার লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শহীদ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সারাদেশের উৎপাদন যন্ত্র অচল থাকলেও হানাদার বাহিনীর নাটোর ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর শেরওয়ানির আশ্বাসে আখ চাষিদের স্বার্থ বিবেচনা করে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের তৎকালীন প্রশাসক লে. আনোয়ারুল আজীম জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মিলের উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ গোপালপুরের ৪ কিলোমিটার উত্তরে লালপুরের ময়না গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ইপিআর, আনসার ও মুক্তিকামী জনগণের মুখোমুখি সংঘর্ষে হয়। পরদিন মেজর রেজা খানকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা ও যোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন রাজাসহ তিন জনকে নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের ভেতরে নিয়ে হত্যা করে। পরে এই মিলের শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তারাও ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন আনোয়ারুল আজীম। মুক্তিকামী জনতা মিলের ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পাশের ঈশ্বরদী এয়ারপোর্টের রানওয়ে অকেজো করে দেয়। ফলে নর্থবেঙ্গল সুগার মিল টার্গেটে পরিণত হয় পাকিস্তান বাহিনীর।

৫ মে সকাল ১১টার দিকে স্থানীয় বিহারিদের সহায়তায় নর্থবেঙ্গল সুগার মিল ঘেরাও করে পাকিস্তানি বাহিনী। পরে মিলে ঢুকে অস্ত্রের মুখে মিলের নিরস্ত্র কর্মকর্তা-শ্রমিক-কর্মচারীদের জিম্মি করে। অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-শ্রমিক-কর্মচারীকে ধরে এনে মিলের ১ নম্বর গেট সংলগ্ন পুকুর ঘাটে (তৎকালীন গোপাল পুকুর) সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এর মধ্যে ছিলেন আনোয়ারুল আজীমও। মরদেহগুলো ফেলে দেওয়া হয় সেই পুকুরেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমে সেই পুকুরের নাম দেওয়া হয় সাগরদিঘী, পরে এর নামকরণ করা হয় শহীদ সাগর।

মিলের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সেই পুকুর পাড়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয় শহীদ স্মৃতি জাদুঘর ও স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৭৩ সালে আনোয়ারুল আজীমের স্মরণে গোপালপুর রেলস্টেশনের নামকরণ করা হয় আজীম নগর।

আনোয়ারুল আজীমের সম্পর্কে জানতে চাইলে তৎকালীন লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিনের মেজ ছেলে সাংবাদিক এসএম মনজুর-উল-হাসান বলেন, পাবনার মুলাডুলিতে স্থানীয় প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সংঘর্ষে তাদের একটি অংশ দলছুট হয়ে লালপুর এলাকায় প্রবেশ করে। এখানেও প্রতিরোধের মুখে পড়ে তারা। পরে ময়না গ্রামের এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বাড়ির সদস্যদের বের করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। এ খবর পৌঁছালে লালপুর থানার ওসি আফতাব উদ্দিন, নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের জিএম লে. আনোয়ারুল আজীমসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা থানা চত্বরে বৈঠক করেন পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন।

এসএম মনজুর-উল-হাসান বলেন, বৈঠকে সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে মিলে ফিরে যান আনোয়ার আজীম। পরে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লালপুর থানার ওসির নেতৃত্বে উপস্থিত পুলিশ, ইপিআর ও সাঁওতাল সদস্যরা ময়না গ্রামের দিকে ধাবিত হয়। সেখানে  পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে প্রতিরোধ বাহিনী। এক সময় তারা পাকিস্তানি বাহিনীর তিন জনকে আটক করে। তাদের সুগারমিলের কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা পোড়াবাবুর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। পরদিন তাদের হত্যা করা হয়।

হত্যার আগে ওই তিন জনের পরিচয় জানতে চাওয়া হলে এক সময় ক্যাপ্টেন পরিচয় দিয়ে একজন জানান, তাদের সঙ্গে রয়েছেন একজন গাড়িচালক, তৃতীয় জন মেজর রাজা আসলাম পাকিস্তানের জেনারেল টেক্কা খানের ভাগনে। প্রথমে ওই ক্যাপ্টেন ও গাড়িচালককে হত্যা করা হয়। আসলাম রাজাকে ছুরিকাঘাত করে আহত করলে তিনি বলেন, তোমরা আমাকে ১০ মিনিট সময় দাও, আমি যুদ্ধ থামিয়ে দিচ্ছি। তবে তার কথায় প্রতিরোধ বাহিনী কর্ণপাত করেনি। সঙ্গী দু’জনের মতো প্রাণ হারাতে হয় তাকেও।

এস এম মনজুর-উল-হাসান বলেন, ‘বাবার (ওসি আফতাব উদ্দিন) কাছে শুনেছি, এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনায় অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আনোয়ারুল আজীম। ওই সময় সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিনই বাবার সঙ্গে আনোয়ারুল আজীমের দফায় দফায় বৈঠক হতো। এমনই একদিন আলোচনা শেষে আনোয়ারুল আজীম তার ব্যক্তিগত একটি ডায়েরিতে কিছু লিখছেন বলে দেখতে পান বাবা। জানতে চাইলে আজীম বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য তার দেওয়া জয়বাংলা পতাকার খরচ, গাড়ির তেল খরচ, মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া আনুষাঙ্গিক সব খরচ তিনি লিখে রাখেন। নর্থবেঙ্গল সুগার মিল সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তিনি ব্যক্তিগতভাবেই খরচ দিতেন এবং ডায়েরিতে তার হিসাব রাখতেন। বিষয়টি জানতে পেরে এমন ডক্যুমেন্ট না রাখতে তাকে বারবার অনুরোধ করেন বাবা। কিন্তু আনোয়ারুল আজীম তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।’
সাংবাদিক এস এম মনজুর-উল-হাসান বলেন, ১৯৭১ সালের  ৫ মে সকালে স্থানীয় কয়েকজন বিহারী চার-পাঁচ জন পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে সুগার মিলে যায়। সেখানে কাউকে খুঁজে না পেয়ে তারা প্রশাসক আজীমের দফতরে প্রবেশ করে। তার সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আনোয়ারুল আজীমের ব্যক্তিগত ডায়েরি চোখে পড়ে তাদের। ডায়েরিতে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ও পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য আনোয়ারুল আজীমের সহায়তার বিষয়টি দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে তারা। তাকে টেনে-হেঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে। আশপাশে থাকা অন্যদেরও ধরে নিয়ে যায় তারা। পরে গোপাল পুকুরের পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই ডায়েরিটি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে না পড়লে হয়তো ওইভাবে প্রাণ দিতে হতো না মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম নির্ভরতা আনোয়ারুল আজীমকে।

লালপুর-বাগাতিপাড়া আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের তৎকালীন প্রশাসক লে.আনোয়ারুল আজীমসহ মিলের শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। আমরা ৪২ জনের তালিকা সংগ্রহ করতে পেরেছি। তাদের শহীদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সংসদে একাধিকবার দাবিও তুলেছি।  দীর্ঘদিন পরে হলেও সরকার আনোয়ারুল আজীমকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান এই সংসদ সদস্য।

 

/টিআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো