X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোদে পুড়ে ক্লাস ও পরীক্ষা, ঝড় আসলেই দৌড়

তরিকুল রিয়াজ, বরগুনা
০৫ মে ২০১৮, ১৬:১৬আপডেট : ০৫ মে ২০১৮, ১৭:২৫

বাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা আকাশের নিচে একটি উঠানে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীরা। কখনও রোদের মধ্যে প্রচণ্ড গরমে তারা ঘেমে অস্থির। আবার কখনও কালবৈশাখী ঝড় শুরু হলে দৌড়ে পাশের কোনও ঘরে আশ্রয় নিচ্ছে তারা। সঙ্গে দৌড়াচ্ছেন শিক্ষকরাও। এভাবেই চলছে বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার বেতাগী পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের বাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।

বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় উপজেলা প্রকৌশলী সেটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেন। যে কোনও সময় ভবন ভেঙে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় গত ২৩ এপ্রিল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে না এই বিদ্যালয়ের ভবনটি। তাই শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও প্রথম সাময়িক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে বসে। অস্বাভাবিক গরমের মধ্যে পরীক্ষা দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।  খোলা আকাশের নিচে চলছে ক্লাস ও পরীক্ষা

সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের পাশের একটি বাড়ির উঠানে খোলা আকাশের নিচে রোদের মধ্যে প্রচণ্ড গরমে পরীক্ষা দিচ্ছে খুদে শিক্ষার্থীরা। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা শুরুর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হঠাৎ করে শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়। শিক্ষকরা দ্রুত শিক্ষার্থীদের পাশের ঘরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। ঘরের মধ্যে চট বিছিয়ে শিক্ষার্থীদের বসে থকেতে হয় বৃষ্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত। পরে তারা তাদের পরীক্ষা সম্পন্ন করে। এমন করেই গত কয়েক দিন ধরে চলছে বাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৫৭ সালে বেতাগী পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডে বাসন্ডা এলাকায় ১৮ শতাংশ জমির ওপর বাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে চার কক্ষ বিশিষ্ট একমাত্র ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ভবনটি নির্মাণে ত্রুটি থাকায় কয়েক বছর যেতে না যেতেই ব্যবহারে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর সংবাদপত্রে  ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে এ বিষয় বেতাগী উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠান। সে অনুযায়ী চলতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি উপজেলা শিক্ষা অফিসারসহ উপজেলা প্রকৌশলী সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা পর্যন্ত  যেকোনও সময় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটতে পারে এই মর্মে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে বেতাগী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পরামর্শ দেন। পরামর্শ অনুয়ায়ী প্রধান শিক্ষক বেতাগী থানায় জিডি করেন। পরে জিডি’র কপি, ছবি ও প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়। খোলা আকাশের নিচে চলছে ক্লাস ও পরীক্ষা

এরপর গত ৯ এপ্রিল উপজেলা প্রকৌশলী ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কার্যক্রম না চালানোর জন্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে চিঠি পাঠান। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে ২৩ এপ্রিল থেকে বিদ্যালয় সংলগ্ন একটি বাড়ির উঠানে ৭ জন নারী শিক্ষক ও ১৩১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় স্থানীয় শিক্ষা অনুরাগী দম্পত্তি  সুধাংশু শেখর হাওলাদার ও তার স্ত্রী এগিয়ে আসেন শিক্ষার্থীদের জন্য। তিনি তাদের বাড়ির উঠান ছেড়ে দিয়েছেন বিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষার জন্য। এমনকি শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য তার ঘরও ছেড়ে দিচ্ছেন স্কুল চলাকালীন সময়। ঝড়ের সময় পাশের বাড়িতে বসে পরীক্ষা

সুধাংশু শেখর হাওলাদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার সন্তানও এই বিদ্যালয়ে একসময় লেখাপড়া করতো। এই যে শিশুরা তারাও তো আমার সন্তানের মতো। আমি যেভাবে পারছি তাদের সাহায্য করছি যেন এখানে ক্লাস বা পরীক্ষা দিতে কোনও সমস্যা না হয়।’ তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘আমি গরীব মানুষ,কিন্তু আমার যে উঠান আছে সেখানেই ওদের জায়গা দিয়েছি। টাকা থাকলে ক্লাস করার জন্য একটি ঘর তুলে দিতাম।’

সুধাংশু শেখর হাওলাদারের স্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এখানে কোনও টিউবয়েল নেই। তাই শিক্ষার্থীদের পানি খেতে কষ্ট হয়। এছাড়া আমরা মোটামুটি সব ধরনের সাহায্য করতে পারছি।’

বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতি বেগম এবং শহীদুল জানায়, ‘স্কুলের বাইরে পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট হচ্ছে। 

বিদ্যালয় ভবনের ওপরে হাঁটলে ভবন কাঁপে। শিক্ষার্থীদের খোলা মাঠে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। প্রচণ্ড গরম এবং হঠাৎ করে আসা বৃষ্টির মধ্যে অনেক কষ্ট হয়।’ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ব্যবহার না করার নির্দেশ

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাধিক অভিভাবক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ভবনটি কয়েক বছর ধরেই ঝুঁকিতে রয়েছে। একটু ঝড়ো বাতাস হলেই ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কায় দ্বিতীয় তলা থেকে শিক্ষার্থীদের নিচে নামিয়ে আনতে হয়। রাস্তা দিয়ে বড় কোনও গাড়ি গেলে ভবনে কাঁপতে থাকে। মনে হয় এখনি ভেঙে পড়বে। কিন্তু এরপরও শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ভবন তৈরি করা হচ্ছে না।  

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘এ রকম খোলা আকাশের নিচে পরীক্ষা দিতে কোমলমতি ছাত্র ছাত্রীদের দারুণভাবে কষ্ট হচ্ছে। তারা কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পরছে।’  

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মুসতারী আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুরা ওপর দিয়ে একটু দৌড় দিলে বা বড়রা কেউ হাঁটলে ভবন কাঁপতে থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, জোরে হাঁটলে টেবিলে রাখা বিভিন্ন জিনিসপত্র কাঁপতে কাঁপতে নিচে পড়ে যায়।’

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কেয়া চৌধুরী ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খুব ভয় নিয়ে আমরা ভবনটিতে ক্লাস করতাম। এখন এটি ঝুঁকিপূর্ণ তাই ভবনটি ব্যবহার না করার জন্য বলা হয়েছে। এখন একটি উঠানে পরীক্ষা নিচ্ছি। গরমের কারণে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে বৃষ্টির মৌসুম আসছে। জানি না শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোথায় যাবো।’

বাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাঈদা পারভীন ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঝুঁকির কারণে আমরাও ভবনে ক্লাস নেওয়ার সাহস পাচ্ছি না। তারপরেও বিকল্প ব্যবস্থা না করেই ভবন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে চরম অসহায় হয়ে পড়েছি। সারাদিন খোলা আকাশের নিচে কাটাচ্ছি। যেকোনও ভাবেই আমাদের পাঠদান চালাতে হবে। দ্রুত এই শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে একটা অস্থায়ী ঘরের দরকার।’ স্কুলের পাশের বাড়ির উঠানে পাতা বেঞ্চ

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও বরগুনা জেলা পরিষদের সদস্য আবুল কাসেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ের নতুন ভবন হবে শুনছি অনেকদিন থেকে। একবার মাটি পরীক্ষাও করা হয়েছে।  কিন্তু এরপর আর কিছুই হয়নি। এখন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ক্লাস নিয়ে বিপদ হলে কে দায়ভার বহন করবে। তবে এখন খোলা আকাশের নিচে ছোট ছোট শিশুরা পরীক্ষা দিচ্ছে এটা খুব মর্মান্তিক। আমরা শিক্ষা অফিসসহ বেশ কয়েকটা অফিসে কথা বলেছি। মূল ভবন করার আগে শিশুদের শিক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।’

বেতাগী উপজেলা প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের কোনও ক্ষমতা আমাদের নেই। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে দুর্যোগ মৌসুম। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।’

উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ভবনটি পরিদর্শন করেছি। এটি আসলেই অনেক ঝুঁকিতে রয়েছে। যে কোনও সময় বিপদ ঘটতে পারে। তাই ওই অবস্থায় পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। বাইরেও শিশুরা অনেক কষ্ট করে পরীক্ষা দিচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভবনটি পুনর্নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক মো. মোখলেছুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খুব তাড়াতাড়ি বেতাগীর বাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করতে যাবো। ইতোমধ্যে বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সরেজমিন পরিদর্শন করতে বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণ কার্যক্রম চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

 

/এসএসএ/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা